টুঙ্গিপাড়া বঙ্গবন্ধুর বাড়ি
টুঙ্গিপাড়া নামটা শুনলে আমাদের স্মৃতির পাতায় যে জিনিসটি সবার আগে ভেসে উঠে সেটি হচ্ছে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নাম। মধুমতি নদীর শাখা নদী বাইগারের গা ঘেঁষে অবস্থিত এই টুঙ্গিপাড়া গ্রাম। গাছগাছালি দিয়ে ছবির মত স্বচ্ছ এই টুঙ্গিপাড়া। এই গ্রামের সাথেই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে আমাদের প্রিয় বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি।
কেননা এই গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। এই স্মৃতি বিজরিত টুঙ্গিপাড়া বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আজও রয়েছে। তবে এই টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর বাড়ী নয়, রয়েছে তাঁর সমাধিসৌধও। চলুন আজকে ঘুরে আসা যাক বঙ্গবন্ধুর এই স্মৃতি বিজরিত টুঙ্গিপাড়া থেকে এবং জেনে আসি বঙ্গবন্ধুর ছেলেবেলা।
আরও পড়ুনঃ কাপ্তাই লেক, রাঙ্গামাটি
কিভাবে আসল এই টুঙ্গিপাড়া নাম
টুঙ্গিপাড়া এই নামটির সাথে বেশি পরিচিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কারনে। কিন্তু কিভাবে বা কোথা থেকে এসেছে এই টুঙ্গিপাড়া নামটি?
লোকমুখে শোনা গিয়েছে পারস্য এলাকা থেকে একজন মুসলিম সাধক এই এলাকার প্লাবিত অঞ্চলে টং বেঁধে বসবাস করছিলেন। সময়ের পরিক্রমায় এই টং নাম থেকেই টুঙ্গিপাড়া নামের উৎপত্তি। বাংলাদেশের দক্ষিণভাগে স্রোতস্বিনী মধুমতি নদীর কোল ঘেঁষে গড়ে উঠেছে টুঙ্গিপাড়া গ্রাম। এই টুঙ্গিপাড়া গ্রামের বুক জুড়ে রয়েছে বাঘিয়া নদী। আরো রয়েছে মাছে ভাতে বাঙালির আধার বর্ণি বাওড়।
যদিও এই টুঙ্গিপাড়া নামটি এসেছে টং নাম থেকে কিন্তু বহু বছর ধরে এই নামটির সাথে বঙ্গবন্ধুর নাম জড়িয়ে গিয়েছে স্মৃতির পাতায়। টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ছাড়াও রয়েছে বঙ্গবন্ধুর হাজারো স্মৃতি।
যেখানে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর বাড়ী
টুঙ্গিপাড়ায় ঢুকতেই সর্বপ্রথম যে জিনিসটা আমাদের চোখে পড়ে সেটি হচ্ছে বঙ্গবন্ধু গেট।
টুঙ্গিপাড়ার চারিদিক ঘিরে যেন রয়েছে ইতিহাস, এর নামকরণ থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত এ অঞ্চলটি নানা ইতিহাসে ঘেরা।টুঙ্গিপাড়ায় শুধু বঙ্গবন্ধুর বাড়ি নয় এখানে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর সমাধি সৌধ। তাছাড়াও রয়েছে ধর্মীয় সাধক পুরুষ মরহুম খানজাহান আলী (রা:) পুণ্যভূমি।
টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদি পৈত্রিক বাড়িও রয়েছে। যেটিকে পুরনো আদলে ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ চলছে। শেখ বোরহান উদ্দিন জানান, এই বাড়িটি বঙ্গবন্ধুর পূর্বপুরুষ জমিদার শেখ কুদরতউল্লাহ প্রায় তিনশ বছর আগে এই বাড়িটি নির্মাণ করেন। তখনকার সময়ে এই বাড়ির সৌন্দর্য দেখে মানুষ মুগ্ধ হয়ে যেত। শুধু তাই নয় বঙ্গবন্ধুর আদি পৈতৃক বাড়িটি অনন্য সুন্দর স্থাপত্য হিসেবে পরিচিত ছিল। এই বাড়িটির দরজা জানালার কারুকাজ করা হয়েছে সেগুন কাঠ দিয়ে। এমনকি এই বাড়ির একপাশে এখনো রয়েছে বৈঠকখানার আসবাবপত্র। এ বাড়িতে কেটেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শৈশবকাল। এমনকি বাড়িতে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমান জন্মগ্রহণ করেছেন। বর্তমান সময়ে বাড়িটির ঐতিহ্য দেখতে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের মানুষ আসে।
টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর আদি বাড়িটিকে নিয়ে কবি সৈয়দ ফখরুদ্দিন মাহমুদ ৩৩ লাইনের একটি কবিতা লিখেছেন যে কবিতাটির নাম “একটি অমর সমাধি।”
আরও পড়ুনঃ নীলগিরি বান্দরবান
নিজ বাড়ির সাথে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি
পড়াশুনার তাগিদে ছাড়তে হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে টুঙ্গিপাড়ার নিজ বাড়ি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র ছিলেন তিনি। সেসময় ঢাকা থেকে টুঙ্গিপাড়ায় নিজ বাড়িতে যাওয়ার একমাএ মাধ্যম ছিল স্টিমার। মধুমতি নদীরপাড়ে পাটগাতি লঞ্চঘাটই ছিল তখনকার সময়ের যাতায়াতের একমাএ মাধ্যম।
এই মধুমতি পাটগাতি লঞ্চঘাট থেকে বঙ্গবন্ধুর নিজ বাড়ি যেতে দুই পাশে পড়ত ছায়া ঢাকা গ্রাম। টুঙ্গিপাড়ার চারপাশের রাস্তা ঘিরে রয়েছে নারিকেল,সুপারি,বনবিথী। টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর বাড়ির পিছনে রয়েছে হিজলগাছের ছায়াতল। যেখানে বসে একসময় অনেক আড্ডা দিয়েছিলেন তিনি।
বাড়ির পিছনের সেই হিজলগাছটি আজও খালপাড়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেই খালপাড়ের হিজলগাছ এবং টুঙ্গিপাড়া বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আজও যেন মানুষকে জানান দিয়ে যাচ্ছে বঙ্গবন্ধুর হাজারো স্মৃতি। টুঙ্গিপাড়া বঙ্গবন্ধুর বাড়ি, বঙ্গবন্ধুর সমাধি সৌধ এর পাশাপাশি আরো দেখতে পাওয়া যায় বঙ্গবন্ধুর ছেলেবেলার খেলার মাঠ, তার প্রিয় বালিশা আম গাছ এবং শেখ বাড়ি জামে মসজিদ। আরো রয়েছে শেখ পরিবারের ঐতিহ্যবাহী একটি বড় ও একটি ছোট আকারের পুকুর।
বঙ্গবন্ধুর সমাধি সৌধ
টুঙ্গিপাড়ায় যেমন জন্মে ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ঠিক তেমনি এই টুঙ্গিপাড়ায় চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর সমাধি সৌধটি গোপালগঞ্জ শহর থেকে ১৯ কিলোমিটার দূরে টুঙ্গিপাড়ায় অবস্থিত। এই সমাধি সৌধে ঢুকতেই সবার আগে চোখে পড়বে কবি সৈয়দ ফখরুদ্দিন মাহমুদের “একটি অমর সমাধি” কবিতার দুইটি লাইন। এর দুই পাশ জুড়ে রয়েছে ফুলের বাগান ও কৃত্রিম পাহাড়।
প্রধান গেট হতে প্রবেশ করে সোজা পশ্চিম পাশে রয়েছে বঙ্গবন্ধুর সমাধি সৌধ। এই প্রধান গেটের বাম পাশেই আছে একটি সমাধিসৌধ ক্যানটিন এবং ডান পাশে আছে বেশ কয়েকটি দোকান। শুধু তাই নয়, ডান দিকে এগিয়ে যেতে চোখে পড়বে লাইব্রেরি এবং বঙ্গবন্ধুর উপর দুর্লভ ছবি ও ডকুমেন্ট নিয়ে গড়ে তোলা মিউজিয়াম এমনকি তার পাশেই রয়েছে থিয়েটার সেন্টার।
থিয়েটার সেন্টারের বিপরীত পাশে রয়েছে সমাধি সৌধ মসজিদ। সমাধিসৌধের সামনে রয়েছে একটি বড় পুকুর এবং পুকুরের চারপাশে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য ছায়া ঘেরা পরিবেশে রয়েছে কিছু বেঞ্চ। তাছাড়াও বঙ্গবন্ধুর সমাধি সৌধ কমপ্লেক্সটির ভিতরে কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়েছে ছোট ছোট ঢিলা পাহাড় এবং বিভিন্ন রঙের ফুলের বাগান।
বঙ্গবন্ধুর এই সমাধি সৌধটি লাল সিরামিক ইট আর সাদা কালো মার্বেল পাথর দিয়ে তৈরি। এর উপরের দেয়ালে রয়েছে জাফরি কাটা। সমাধি সৌধের দুই পাশের উদ্যান তাহলেই বঙ্গবন্ধুর কবর। বঙ্গবন্ধুর কবরের পাশেই রয়েছে তার বাবা-মায়ের কবর।
বঙ্গবন্ধুর কবরটি চারপাশে কালো এবং মাঝখানের সাদা মার্বেল পাথর দিয়ে বাঁধানো এবং উপরের অংশটি ফাঁকা। প্রতিদিন হাজার হাজার দর্শনার্থী এই সমাধি সৌধটিকে দেখতে আসেন।
দর্শনার্থীদের সুবিধার জন্য জানিয়ে দিচ্ছি এই সমাধি সৌধটি প্রতিদিন সকাল ৮ টা থেকে ৬টা ও পাঠাগারটি সকাল ৯টা থেকে ৫টা পর্যন্ত খোলা থাকে।
শেষ কথা
টুঙ্গিপাড়া বঙ্গবন্ধুর বাড়ি থেকেই তার যাত্রা শুরু হয়েছিল এবং টুঙ্গিপাড়ায় তার নিজ বাড়ির পাশেই তার বাবা মায়ের সাথে চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে আছেন। ৫৫ বছরের জীবনযাত্রা ছিল তার। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট তিনি শাহাদাত বরণ করেন। যদিও বঙ্গবন্ধুর জীবনযাত্রা ছিল ৫৫ বছরের কিন্তু তার স্মৃতি তার টুঙ্গিপাড়ার বাড়ির দেয়ালে দেয়ালে আজও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
কেননা এই বাড়িতে তার ছেলেবেলা ও কৈশোরের সুন্দর সময় কেটেছে। এই বাড়িতে তার বিয়ে হয়েছে বঙ্গমাতা সায়েরা খাতুনের সাথে। এই বাড়িতেই তিনি বিভিন্ন সালিশ করেছেন। এই বাড়িতেই তিনি খেলেছেন, বড় হয়েছেন, আড্ডা দিয়েছিলেন আর এখানেই তিনি চিরকালের জন্য ফেরত এসেছেন।বঙ্গবন্ধুর টুঙ্গিপাড়া বাড়ি চিরকাল তার স্মৃতি বলে যাবেন মানুষের কাছে।
টুঙ্গিপাড়া বঙ্গবন্ধুর বাড়ি সম্পর্কিত প্রশ্ন ও উত্তর / FAQ’s
১.শেখ মুজিবের কবর স্থান কোথায় ?
উত্তর: এটি মুজিবের জন্মস্থান গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় অবস্থিত এবং এটি স্থপতি এহসান খান, ইশতিয়াক জহির ও ইকবাল হাবিব নকশা করেছেন।
২.কত তারিখে বঙ্গবন্ধুকে সমাধিস্থ করা হয় ?
উত্তরঃ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকের বুলেটে শাহাদত বরণ করেন তিনি। পরের দিন টুঙ্গিপাড়ায় পারিবারিক কবরস্থানে মা ও বাবার পাশে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
৩.গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া কোন নদীর উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে ?
উত্তরঃ বিখ্যাত নদী মধুমতি বাগেরহাট জেলা থেকে টুঙ্গিপাড়াকে বিভক্ত করেছে এবং ঢাকা-খুলনা বিভাগের বিভাজক।
আরও পড়ুন-
শালবন বিহার, কুমিল্লা
মধুটিলা ইকোপার্ক, শেরপুর