টাংগুয়ার হাওর, সুনামগঞ্জ, ভ্রমণ অভিজ্ঞতা

টাংগুয়ার হাওর

টাংগুয়ার হাওর সুনামগঞ্জ জেলাতে প্রায় ১০০ বর্গ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে অবস্থিত। টাঙ্গুয়ার হাওরকে বলে নয় কুড়ি কান্দার ছয় কুড়ি বিল। বর্তমানে হাওড়টি সবার কাছেই পরিচিত কিন্তু অতীতে খুব বেশি পরিচিত ছিল না। ২০২২ সালে এর জনপ্রিয়তা বেড়েছে বিভিন্ন আকর্ষণীয় ও ব্যয়বহুল হাউজবোটের কল্যাণে।

এই টাংগুয়ার হাওর যতদূর চোখ যাবে শুধু দেখতে পাবেন থৈ থৈ পানি। হাওরের এক প্রান্তে রয়েছে ভারতের মেঘালয়ের পাহাড় এবং সেখান থেকে ৩০ টি ঝর্ণাধারা নেমে এসেছে। তার সঙ্গে রয়েছে বিশাল প্রশান্তময় নীল আসমান যেন মিশে গেছে হাওরের বুকে।

এই হাওরের আয়তন সাত হাজার একর কিন্তু বর্ষায় তা বেড়ে তিন গুন হয়। বর্ষার সময় হাওরের পুরোটি ডুবে থাকলেও শীতকালে পানি শুকিয়ে যায়। টাংগুয়ার হাওর কে বলা হয় মাদার ফিশারী। তবে এ হাউর শুধু মাছ পালন ও সংরক্ষণের স্থান নয় বরং মোহনীয় সৌন্দর্যের মিলন মেলা।

সারি সারি হিজলের নন্দনীয় দৃশ্য এছাড়াও পানিফল নীল শাপলা শতমূলী স্বর্ণলতা বন তুলসী দুধিলতা ইত্যাদি ছাড়াও প্রায় ২০০ রকমের গাছ গাছালি রয়েছে এখানে। টাঙ্গুয়ার হাওর (tanguar haor) সবার থেকে বৈচিত্র্যময় এমন দর্শনীয় স্থান আর কোথাও নেই। তাই কোন বিদেশি পর্যটক বাংলাদেশের দর্শনীয় এই জায়গার নাম জানতে চাইলে ট্রাভেল এক্সপার্টরা টাঙ্গুয়ার হাওরের নাম সাজেস্ট করেন।

আরও পড়ুনঃ সিলেটের দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ

টাংগুয়ার হাওর ভ্রমণের উপযুক্ত সময়

টাংগুয়ার হাওর

টাংগুয়ার হাওর ভ্রমণ করার উপযুক্ত সময় হলো বর্ষাকাল। বর্ষার সময় মেঘালয়ের পাহাড়ের ঝরনা গুলো থেকে পাহাড়ি ঢলে হাওর যেন কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠে। জুলাই মাস থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত টাঙ্গুয়ার হাওর (sunamganj tanguar haor) ভ্রমণের জন্য উপযুক্ত সময় বলে মনে করা হয়। শীতকালেও এই হাওরের সৌন্দর্য বেড়ে যায় কেননা এই সময় লাখ লাখ পাখির আনাগোনা শুরু হয়।

যারা পাখি প্রেমী তাদের জন্য শীতকাল হবে হাওড়া ভ্রমণের জন্য উপযুক্ত সময়। তবে টাঙ্গুয়ার হাওরে যে সময় যান না কেন এর সৌন্দর্য, মাধুর্য এবং বৈচিত্র্য আপনাকে মুগ্ধ করিয়ে ছাড়বে। এছাড়াও আরো একটি মজার বিষয় দেখতে পাবেন তা হল পাশাপাশি দুই বাড়িতে বিয়েও হয় নৌকায়।

টাংগুয়ার হাওর দর্শনীয় স্থান

টাংগুয়ার হাওর (tanguar haor) পুরোটাই সৌন্দর্যে ভরপুর। কিন্তু এখানে ঘুরার  জন্য রয়েছে অনেক জায়গা। টাঙ্গুয়ার হাওরে গেলে সবগুলো জায়গায় ঘুরে আসতে পারেন,

  • ওয়াচ টাওয়ার
  •  নীলাদ্রি লেক (শহীদ সিরাজ লেক)
  • শিমুল বাগান
  •  জাদুকাটা নদী 
  • লাউয়ের গড়  
  • বাঁশবাগান 
  • লকমা ছড়া 
  • ছোট ছোট সোয়াম্প ফরেস্ট 
  • বারিক্কা টিলা 

এছাড়াও হাওরে চাঁদনী রাতে জোছনা এবং  হাওরের অপূর্ব সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত যা আপনার চোখ দুটিকে প্রশান্তিতে ভরিয়ে তুলবে।

কিভাবে যাবেন

টাঙ্গুয়ার হাওর যাওয়ার দুইটি পথ রয়েছে 

  • সুনামগঞ্জ বা তাহেরপুর হয়ে টাঙ্গুয়ার হাওর
  • নেত্রকোনা থেকে মোহনগঞ্জ থেকে ধর্মপাশা থেকে মধ্যনগর হয়ে টাঙ্গুয়ার হাওর

ঢাকা টু সুনামগঞ্জ

সায়েদাবাদ মহাখালী এবং ফকিরাপুল থেকে প্রতিদিন শ্যামলী, মামুন, হানিফ এবং এনা পরিবহনের মাধ্যমে সরাসরি বাস রয়েছে যা সুনামগঞ্জে যায়। বাসের ভাড়া ৭৫০ টাকা তবে নন এসিতে। ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ পৌঁছাতে প্রায় ছয় ঘন্টা সময় লাগে। 

সিলেট টু সুনামগঞ্জ

সিলেটে কুমারগাঁও বাস স্ট্যান্ড হতে সুনামগঞ্জ যেতে বাস ভাড়া লাগে ১০০ টাকা আগে দুই ঘন্টার মতো। এছাড়াও আপনি শাহজালাল মাজার থেকে যেতে চাইলে লাইট গাড়ির ভাড়া লাগবে ২০০ টাকা। 

সুনামগঞ্জ টু টাঙ্গুয়া 

সুনামগঞ্জ বাস স্ট্যান্ড থেকে নেমে সুরমা ব্রিজের উপর দিয়ে তাহিরপুর যাওয়ার জন্য লেগুনা, সিএনজি এবং বাইক পাওয়া যায় এতে সময় লাগবে দেড় ঘন্টা। তাহিরপুর নেমে ঘাটে গিয়ে লোক সংখ্যা অনুযায়ী বড় বা ছোট ধরনের ট্রলার ভাড়া নিতে পারবেন। এছাড়াও এখানে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত অসংখ্য হাউজবোট পাবেন কিন্তু হাউজবোট নিতে চাইলে বুকিং করে রাখতে হবে।

বর্ষার সময় সুনামগঞ্জের সাহেব বাড়ি ঘাট হতে ট্রলার বা হাউজবোট রিজার্ভ করতে পারবেন তাহলে তাহেরপুরে সড়কপথে যেতে দেড় ঘন্টা সময় লাগবেনা। আর শীতকালে লেগুনা, সিএনজি বা বাইকে  সোলেমানপুর যেতে হবে এবং সেখান থেকেই ট্রলার ভাড়া করা যাবে। 

নেত্রকোণা টু টাঙ্গুয়ার হাওর

ট্রেনে গেলে, 

ঢাকা থেকে রাতের হাওর এক্সপ্রেস ট্রেনে মোহনগঞ্জ। মোহনগঞ্জ থেকে অটো/লেগুনা/বাইকে ধর্মপাশা বা সরাসরি মধ্যনগর।

মধ্যনগর থেকে রিজার্ভ ট্রলারে টাঙ্গুয়ার হাওর যেতে প্রায় ৩ ঘন্টা সময় লাগবে। টাঙ্গুয়া যেতে অনেকগুলো ছোট, বড় বিল ও হাওর পাড়ি দিতে হবে।

বাসে গেলে,

ঢাকা থেকে বাসে নেত্রকোণা। এরপর বাইকে মধ্যনগর বাজার। অথবা বাসে সরাসরি মোহনগঞ্জ/ মধ্যনগর বাজার। মধ্যনগর থেকে ট্রলারে টাঙ্গুয়ার হাওর।

টাংগুয়ার হাওর ট্রলার ভাড়া

ট্রলার ভাড়া সাধারণত কয়েকটি বিষয়ের উপর নির্ভর করে সেগুলো হলো:

  • ট্রলারের আকার -আকৃতি ও ধারণ ক্ষমতার ওপর সিজন অনুযায়ী 
  • ট্রলারের সুযোগ-সুবিধা অনুযায়ী
  •  ভ্রমণের দিন (টানা ছুটিতে একরকম ভাড়া বাস শুক্র শনিবারে, সপ্তাহের মধ্যে আবার আরেক রকম ভাড়া)

যখন ট্রলার ভাড়া করবেন তখন ট্রলারের যে যে বিষয় দেখে নেওয়া উচিত-

  • ট্রলারে লাইফ জ্যাকেট আছে কিনা 
  • টয়লেট ব্যবস্থা কেমন
  • সোলার প্যানেল ও সামিয়ানা ব্যবস্থা আছে কিনা
  • ফ্যান ও লাইটিং এর ব্যবস্থা থাকবে কিনা

ট্রলারের আকার অনুযায়ী ভাড়া বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। পুরো দিনের জন্য একটি ছোট ট্রলার দুই থেকে তিন হাজার টাকা, মাঝারি ট্রলারে ৩৫০০-৪৫০০ টাকা এবং বড় ট্রলারে পাঁচ থেকে সাড়ে সাত হাজার টাকা ভাড়া লাগে। তবে একরাত ট্রলারে (tanguar haor boat rent) থাকলে ছোট ট্রলারে ভাড়া লাগে চার থেকে ছয় হাজার টাকা,

মাঝারি ট্রলারে সাড়ে ছয় হাজার থেকে সাড়ে সাত হাজার টাকা এবং বড় ট্রলারে ৮০০০- ১২০০০ টাকায় ভাড়া নেওয়া যায়। বড় ধরনের ট্রলারে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ জন বসে থাকতে পারে এবং রাতে ১০ থেকে ১২ জন ঘুমোতে পারে আর মাঝারি ধরনের ট্রলারে ১৫ থেকে ২০ জন বসতে পারে এবং সাত থেকে আট জন রাতে ঘুমোতে পারে তবে মাথায় রাখতে হবে ট্রলার নৌকা নয় তাই ট্রলারকে নৌকা ভেবে ভুল করবেন না সেজন্য ভাড়ায় রয়েছে পার্থক্য।

নৌকা ভাড়া

সাধারণত মাঝারি আকারের একটা নৌকা ভাড়া ৫০০০ থেকে ৭০০০ টাকা। এসব নৌকায় ১৫/২০ জন বসতে পারে, ৭/৮ জন রাতে ঘুমাতে পারে। বড় নৌকার ভাড়া ৭০০০ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়। বড় নৌকাতে বসতে পারে ৩০/৩৫ জন, রাতে ঘুমাতে পারে ১০/১২ জন। নৌকা নেওয়ার সময় সোলার আছে কিনা, টয়লেটের অবস্থা কেমন ইত্যাদি দেখে নিতে হবে।

এছাড়া টাংগুয়া হাওরে আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্পন্ন দুই তিনটি বোট আছে। এগুলোতে জেনারেটর থেকে শুরু করে হাই কমোড, লাইট ফ্যান, গ্যাসের চুলা ইত্যাদি রয়েছে। এসব নৌকায় প্রায় ৪০ জন বসতে পারে। রাতে ঘুমাতে পারে ১৪ থেকে ১৮ জন। দুইদিনের জন্য এসব নৌকার ভাড়া পড়ে ১২ থেকে ১৮ হাজার টাকা পর্যন্ত। তবে সব ধরণের নৌকা ভাড়া শুক্র শনিবারে কিছুটা বেশি ও অন্যান্য দিন কিছুটা কম থাকে।

ভ্রমণ খরচ 

ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ আসা যাওয়া বাস ভাড়া লাগবে পনেরশ টাকা। সুনামগঞ্জ হতে তাহিরপুর যাওয়া-আসা জনপ্রতি ৩০০থেকে ৬০০ টাকা। ট্রলার ভাড়া লাগবে ৫ থেকে ১৫০০০ টাকা যা দলের সদস্য অনুযায়ী ভাগ হবে। 

খাবারের জন্য প্রতিবেলা ১২০ থেকে ২০০ টাকা জনপ্রতী খরচ হবে। এছাড়া আরো দেড়শ থেকে আড়াইশো খুচরা টাকা জনপ্রতি খরচ হবে। ট্রলারের ধরন অনুযায়ী ৪৫০০ থেকে ৫৫০০ টাকা খরচ হতে পারে আনুমানিক ১০ জনের গ্রুপে। 

যদি হাউসবোটের ভ্রমণ  করেন তবে সুনামগঞ্জ আসা-যাওয়ার খরচ বাদে সব খরচ প্যাকেজের মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত থাকে।

থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা

টাঙ্গুয়ার হাওর (tanguar haor) রাতে থাকার জন্য ভালো কোন হোটেলের ব্যবস্থা নেই। তবে হাওরের মাঝখানে হাওর বিলাস নামে একখানা কটেজ (tanguar haor resort) রয়েছে এবং টেকেরঘাটে একটি  বোর্ডিং ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়াও তাহিরপুর বাজার, সুনামগঞ্জে কিছু হোটেল ও বোর্ডিং ব্যবস্থা রয়েছে।

অনেকেই রাতটুকু ট্রলারে কাটিয়ে দেন এটি অন্যরকম এক ধরনের রোমাঞ্চনীয় অভিজ্ঞতা। তবে সুনামগঞ্জে ২০০ থেকে শুরু করে এক হাজার টাকার মধ্যে হোটেল ভাড়া পাওয়া যায়। কিছু হোটেলের নাম উল্লেখ করা হলো :

  • হোটেল সারপিনিয়া -জগন্নাথবাড়ি রোড, সুনামগঞ্জ 
  • হোটেল মিজান, পূর্ব বাজার, সুনামগঞ্জ
  • সুরমা ভ্যালি আবাসিক রিসোর্ট 
  • হোটেল নূরানী, পুরাতন বাস স্ট্যান্ড, সুনামগঞ্জ 
  • হোটেল প্যালেস, পুরাতন বাস স্ট্যান্ড, স্টেশন রোড 
  • হোটেল নূর -পূর্ব বাজার, স্টেশন রোড সুনামগঞ্জ

টাঙ্গুয়ার হাওর (tanguar haor) টেকেরঘাট ও তাহেরপুর এলাকায় বেশ কিছু খাবারের হোটেল আছে। এসব হোটেলে হাওরের বিভিন্ন প্রজাতির সুস্বাদ মাছের তরকারি পাওয়া যায় এছাড়াও দেশি মুরগি বা হাস বিভিন্ন রকমের ভর্তা ইত্যাদি দিয়ে দুপুরের ও রাতের খাবার খেতে পারেন।

আবার চাইলে নিজেরাও তাহিরপুর ও টেকেরঘাট বাজার থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে রান্না করতে পারেন এতে করে খরচ কম হবে। নিজেরা রান্না করতে না চাইলে মাঝেকে বলে একজন বাবুর্চি ব্যবস্থা করতে পারবেন বোটে বা ট্রলারে। দুই দিনের জন্য বাবুর্চি কে পনেরশো টাকার মতো দিতে হবে।

শেষকথা

পরিশেষে বলতে চাই একটি ভ্রমণের পরিকল্পনা বেশ সময়সাপেক্ষ। তাই টাংগুয়ার হাওর (tanguar haor) ভ্রমণের জন্য চাই পুরোদস্তুর প্রস্তুতি। ভ্রমণের পূর্বে নিজের সকল প্রয়োজনীয় জিনিস নেয়ার সাথে নিবেন আরো কিছু জরুরি জিনিস ক্যাপ বা হ্যাট, সানগ্লাস, পাওয়ার ব্যাংক, খাবার পানি, ঔষধ ইত্যাদি। ঘুরতে গিয়ে প্রয়োজনীয় কিছু না পেলে ঘুরাটাই পানসে লাগবে। তাই ভ্রমণ সুন্দর করতে একটি পরিপূর্ণ পরিকল্পনা দরকার সাথে নিজের মধ্যে উদ্যমী মনোভাব।

টাঙ্গুয়ার হাওর সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন ও উত্তর / FAQ

১.টাঙ্গুয়ার হাওর কোথায় অবস্থিত?

উত্তর: সুনামগঞ্জ জেলায়।

২. টাঙ্গুয়ার হাওর কিভাবে যেতে হয়??

উত্তর: ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ বাস বা ট্রেনে এরপর হাওরে ট্রলার বা হাউসবোটে।

৩. ট্রলার না হাউসবোট কোনটি বেশি ভালো?

উত্তর: হাউসবোটে বেশি সুযোগ-সুবিধা তবে খরচ বেশি।

আরও পড়ুন – 

সেন্টমার্টিন দ্বীপ ভ্রমণের সকল তথ্য

শরীয়তপুরের দর্শনীয় স্থান

মন্তব্য করুন