শোলাকিয়া ঈদগাহ কিশোরগঞ্জ

শোলাকিয়া ঈদগাহ

ঈদ হলো মুসলিম উম্মাহর জাতীয় উৎসব। মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের জন্য দুইটি মহোৎসব ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আযহা। ঈদের সকালে দুই রাকাত ওয়াজিব নামাজ ঈদের খুশির অন্যতম উপকরণ। ঈদের নামাজের জন্য ঈদগাহ ময়দানগুলো সুসজ্জিত করা হয়।

আজকে আলোচনা করব বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী শোলাকিয়া ঈদগাহ (Sholakia Eidgah) ময়দান নিয়ে। কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দান। বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশের দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ ঈদগাহ ময়দান এটি। এই ময়দানে প্রতি বছর ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আযহা নামাজের জামাত অনুষ্ঠিত হয়।

ঈদগাহ ময়দানটি কালের স্রোতে পরিণত হয়েছে একটি ঐতিহাসিক স্থানে।  ঐতিহাসিক এই ঈদগাহ ময়দানে ১৭৫০ সাল থেকে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। ঈদগাহ ময়দান প্রতিষ্ঠার ৭৮ বছর পর অর্থাৎ ১৮২৮ সালে প্রথম বড় জামাত অনুষ্ঠিত হয় ।

এই জামাতে একসঙ্গে ১ লাখ ২৫ হাজার অর্থাৎ সোয়ালাখ মুসল্লী একত্রে ঈদের নামাজ আদায় করেন । সোয়ালাখ থেকে এর নামকরণ হয় “সোয়ালাখিয়া”। উচ্চারণ বিবর্তনে এর নাম এখন “শোলাকিয়া” । বর্তমানে শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে একসঙ্গে প্রায় তিন লক্ষাধিক মুসল্লী একসঙ্গে জামাতে নামাজ আদায় করেন।

আরও পড়ুনঃ বায়েজিদ বোস্তামী মাজার – চট্টগ্রাম

ইতিহাস 

কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের পূর্বে নরসুন্দা নদীর তীরে অবস্থিত ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দান। ১৭৫০ সাল থেকে এই মাঠে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। কিন্তু সবচেয়ে বড় জামাত প্রথম অনুষ্ঠিত হয় ১৮২৮ সালে গোরাপত্তনের ৭৮ বছর পর। সোয়ালাখ মুসল্লি একত্রে ঈদের জামাতে নামাজ আদায় করেছিলেন। যার কারনে এর নাম হয় সোয়ালাখিয়া যা বিবর্তনে নাম শোলাকিয়া হয়।

ইসলামের ঐশী বাণী প্রচার করার জন্য সুদূর ইয়েমেন থেকে আগত শোলাকিয়া “সাহেব বাড়ির” পূর্বপুরুষ সুফি সৈয়দ আহমেদ তার নিজস্ব তালুকে নরসুন্দা নদীর তীরে ১৮২৮ সালে  আয়োজন করেন ঈদের জামাতের। সেই জামাতে সুফি সৈয়দ আহমেদ নিজেই ইমামতি করেছিলেন। 

১৯৫০ সালে স্থানীয় হয়বতনগর দেওয়ান পরিবারের অন্যতম দেওয়ান মান্নান দাদ খানের বদান্যতায় শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠের কলেবর বৃদ্ধি পায়। এ মাঠের পরিধি বিস্তৃত লাভ করে। তিনি অতিরিক্ত ৪.৩৫ একক জমি দান করেছিলেন এই মাঠের জন্য । বীর ইশা খাঁর অধঃস্তন বংশধর ছিলেন দেওয়ান মান্নান দাদ। বর্তমানে ঈদগাহ মাঠটির আয়তন প্রায় ৭ একর। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এমনকি বিদেশ থেকেও অনেক মুসল্লির আগমন ঘটে এই মাঠে ঈদের জামাতে নামাজ আদায় করার জন্য। 

মাঠের বর্ণনা 

বর্তমানে শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানের আয়তন প্রায় ৭ একর (৬.৬১ একর)। এই মাঠের পশ্চিম সীমারেখা উত্তর-দক্ষিণে ৩৩৫ ফুট, পূর্ব সীমারেখা উত্তর-দক্ষিণে ৩৪১ ফুট, উত্তর সীমারেখা পূর্ব-পশ্চিমে ৭৮৮ ফুট এবং দক্ষিণ সীমারেখা পূর্ব-পশ্চিমে ৯৪১ ফুট দৈর্ঘ্য। শোলাকিয়ার পূর্ব প্রান্তে দু’তলা বিশিষ্ট একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে । এই মাঠে ২৬৫ সারির প্রতিটিতে ৫০০ জন করে মুসল্লি দাড়াবার ব্যবস্থা আছে।

সব মিলিয়ে মাঠের ভেতর এক লাখ ৩২ হাজার ৫০০ জন মুসল্লী নামাজ আদায় করতে পারেন। ঈদের সময় শুধু এই মাঠেই নয় আশেপাশের সড়ক, খোলা জায়গায়, সেতু এমনকি বাড়ির উঠানেও মুসল্লীরা নামাজ আদায় করেন। এভাবে প্রায় তিন লাখ মুসল্লী একত্রে ঈদের জামাতে নামাজ আদায় করেন। শোলাকিয়া ঈদগাহ এর ব্যবস্থাপনার জন্য ৫১ সদস্যের কার্যনির্বাহী কমিটি আছে। 

ঈদের জামাত 

ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আযহা দুই ঈদেই জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করেন এখানে মুসল্লিরা। আগত সকল মুসল্লিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য শটগানের গুলি ছুঁড়ে জামাত শুরুর সংকেত দেওয়া হয়। রেওয়াজ অনুসারে, জামাত শুরু হওয়ার ৫ মিনিট আগে ৩ টি, ৩ মিনিট আগে ২ টি এবং ১ মিনিট আগে ১ টি শটগানের গুলি ছোড়া হয়। নামাজ শেষ হওয়ার পর দেশ, জাতি এবং মুসলিম উম্মাহর জন্য মঙ্গল কামনা করে মোনাজাত পরিচালিত হয়। 

কিশোরগঞ্জ মূল শহর থেকে ঈদগাহ মাঠ পর্যন্ত প্রায় ১ কিলোমিটার রাস্তায় মানুষের ঢল নামে। শহরের হোটেলগুলোতে বাড়তি লোকের চাপ পরে। আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতেও অনেক লোকের সমাগম হয়। ঈদের জামাতকে কেন্দ্র করে মেলা বসে ঈদগাহের পাশে। মেলাতে পাওয়া যায় তসবিহ, টুপি, সুন্নাতী লাঠি, রেহাল, সুরমা, জলচকি, পিঁড়ি, কুটির শিল্পজাত দ্রব্যাদি, বিভিন্ন ধরনের কাঠের খেলনা ইত্যাদি।

কথিত আছে, তৎকালীন পাকিস্তান আমল এবং ব্রিটিশ শাসনামলে শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠে সুদূর আসাম ও কুচবিহার থেকে অসংখ্য ধর্মপ্রাণ মুসল্লী এখানে আগমন করতেন ঈদের নামাজ আদায় করার জন্য। এখনো কিশোরগঞ্জ জেলা শহর সহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের হাজারো মুসলমান অংশগ্রহণ করেন এই জামাতে।

আরও পড়ুনঃ শালবন বিহার, কুমিল্লা

কিভাবে যাবেন 

যেকোনো জায়গা থেকে প্রথমে আপনাকে কিশোরগঞ্জ জেলায় আসতে হবে এই ঈদগাহ ময়দানে। ট্রেনে বা বাসে করে কিশোরগঞ্জে যেতে পারবেন। শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠ। কিশোরগঞ্জ জেলা সদরে যেকোনো ব্যক্তি কে জিজ্ঞেস করলেই এর অবস্থান সম্পর্কে জানতে পারবেন। 

বাসে ঢাকা-শোলাকিয়া

বাসে করে ঢাকা থেকে কিশোরগঞ্জ যেতে হলে মহাখালী বা গোলাপবাগ বাস স্ট্যান্ড থেকে কিশোরগঞ্জগামী বাসে (অনন্যা সুপার, যাতায়াত, ইশা খাঁ) করে গাইটাল বাসস্ট্যান্ডে নামুন। বাস ভাড়া ২৭০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত। এরপর ৪০ টাকা রিক্সা ভাড়া অথবা ১০ টাকায় লোকাল ইজিবাইকে চলে আসুন ঈদগাহ মাঠে। 

ট্রেনে ঢাকা-শোলাকিয়া

রাজধানী ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশন অথবা বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন থেকে সকাল ৭:১৫ মিনিটে এগারোসিন্ধুর আন্তঃনগর ট্রেনে উঠলে কিশোরগঞ্জে পৌঁছে যাবেন ১১ টার মধ্যে। ট্রেনের টিকেট ভাড়া শ্রেণীভেদে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। রেল স্টেশনে নেমে ২৫ টাকা রিক্সা ভাড়া দিয়ে সহজেই চলে যেতে পারবেন শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে। 

ঈদ স্পেশাল সার্ভিস

দূর থেকে যদি ঈদের জামাতে অংশগ্রহণ করতে আসেন তাহলে উচিত হবে আগের দিনই চলে আসা। এছাড়াও এখানে ঈদের জামাতের জন্য ভৈরব এবং ময়মনসিংহ থেকে স্পেশাল ট্রেন সার্ভিস চালু থাকে। ঈদের দিন খুব সকালে, কিশোরগঞ্জের উদ্দেশ্যে স্পেশাল দুটি ট্রেন ছেড়ে আসে। 

রিজার্ভ গাড়ি

যদি অনেকজন মিলে ঈদের জামাতে অংশগ্রহণ করতে চান তাহলে বাস অথবা কোন প্রাইভেট গাড়ি রিজার্ভ করে চলে আসতে পারেন। ঈদের নামাজ আদায় করার পর আবার একই গাড়িতে চলে যাবেন। 

কোথায় থাকবেন 

আপনি যদি ঈদের আগের দিন কিশোরগঞ্জে যান তাহলে রাত্রে থাকার জন্য কিশোরগঞ্জ সদরের স্টেশন রোড এলাকায় বেশ কিছু ভাল মানের আবাসিক হোটেল রয়েছে। এরমধ্যে রিভারভিউ, গাংচিল, নিরালা, উজানভাটি, ক্যাসেল সালাম উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও অনুমতি সাপেক্ষে থাকতে পারবেন জেলা সদরের সরকারি ডাকবাংলোতে। 

কোথায় খাবেন  

খাওয়ার জন্য কিশোরগঞ্জ শহরের ধানসিঁড়ি, দারুচিনি, গাংচিল, তাজ, ইষ্টিকুটুম, মাছরাঙ্গা ইত্যাদি রেস্টুরেন্টে যেতে পারেন। পেয়ে যাবেন আপনার পছন্দের খাবার। মিষ্টি পছন্দ করলে অবশ্যই একরাম্পুরের লক্ষী নারায়ন মিষ্টান্ন ভান্ডার অথবা মদন গোপালে গিয়ে মিষ্টি খেতে ভুলবেন না। 

শেষকথা 

প্রতিবছর ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনায় লাখো মুসল্লির সমাগম ঘটে কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে। ঈদের জামায়াত নির্বিঘ্নে করতে ব্যাপকহারে নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। নিরাপত্তার জন্য র‍্যাপিড একশন ব্যাটেলিয়ন (র‍্যাব) , আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন), রেঞ্জ রিজার্ভ ফোর্স, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এবং জেলা পুলিশের সদস্য মোতায়েন করা হয়।

এছাড়াও মাঠের ভিতরে এবং বাহিরে লাগানো হয় সিসিটিভি ক্যামেরা। পুরো মাঠকে পর্যবেক্ষণ করার জন্য ড্রোনেরও ব্যবস্থা করা হয়। আগত ব্যক্তিদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করা হয়, পর্যবেক্ষণ টাওয়ারের মাধ্যমে।

ঐতিহ্যবাহী শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠে অনেক খ্যাতিসম্পন্ন আলেমগণ ইমামতি করেছেন। প্রথম বড় জামাতের পর যারা ইমামতি করেছেন তারা হলেন – হযরত মাওলানা হাফেজ মুহাম্মদ হযরত উল্লাহ, হযরত মাওলানা পেশোয়ারী, হযরত মাওলানা মুসলেহ উদ্দিন, আলহাজ্ব মাওলানা হামিদুল হক ইত্যাদি।  

শোলাকিয়া ঈদগাহ সম্পর্কিত প্রশ্ন এবং উত্তর / FAQ’s 

১. শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দান কোথায় অবস্থিত? 

উত্তর : কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের পূর্বে নরসুন্দা নদীর তীরে ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দান অবস্থিত। 

২. শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দান কতটুকু জায়গার উপর অবস্থিত? 

উত্তর : শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দান প্রায় ৭ একর (৬.৬১ একর) জায়গার ওপর অবস্থিত। 

৩. বর্তমানে শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠের ইমাম কে? 

উত্তর : বর্তমানে শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠের ইমাম  ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ। 

৪. শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠের ধারণ ক্ষমতা কত? 

উত্তর : শোলাকিয়া ঈদগাহ মাঠে ২৬৫ সারির প্রতিটিতে ৫০০ জন করে মুসল্লি দাড়াবার ব্যবস্থা আছে। সব মিলিয়ে মাঠের ভেতর এক লাখ ৩২ হাজার ৫০০ জন মুসল্লী নামাজ আদায় করতে পারেন।

আরও পড়ুন- 

নীলগিরি বান্দরবান

রেডিয়েন্ট ফিস ওয়ার্ল্ড, কক্সবাজার

মন্তব্য করুন