ষাট গম্বুজ মসজিদ
মসজিদ হলো আল্লাহর ঘর। যেখানে মানুষ আল্লাহকে স্মরণের উদ্দেশ্য সালাত আদায় করে। বাংলাদেশের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী মসজিদ গুলোর মধ্যে ষাট গম্বুজ মসজিদ হলো বেশ প্রাচীন। বর্তমানে যার বয়স ৬৫০ বছর প্রায়।
মসজিদটির অপরুপ স্থাপত্যশিল্পের জন্য বরাবর ই দর্শনার্থীদের নিজর কাড়ে৷ যাকে ঘিরে রয়েছে অজানাসব তথ্য। ১৫’শ শতাব্দীর এই মসজিদটি বাগেরহাট জেলায় অবস্থিত, এই কারণে ১৯৮৫ খ্রীস্টাব্দে ইউনেস্কো বাগেরহাট শহর কে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের সম্মাননা প্রদান করেছে।
আজকে আমরা বাংলাদেশের প্রাচীনতম এই মসজিদ সম্পর্কে বিস্তারিত জানানোর চেস্টা করবো। আমাদের এই লেখা থেকে আপনি আরো জানতে পারবেন ঢাকা থেকে কিভাবে আপনি বাগেরহাটে পৌছাতে পারেন। এমন আরো অনেক কিছু জনতে আমাদের লেখাটি আপনাকে অবশ্যই শেষ পর্যন্ত পড়তে হবে।
আরও পড়ুনঃ কুসুম্বা মসজিদ , নওগাঁ
ষাট গম্বুজ মসজিদ এর গঠন ও বিবরন
দৃষ্টিনন্দন ষাট গম্বুজ মসজিদ (shat gombuj mosque) বাংলাদেশের খুলনা বিভাগের বাগেরহাট জেলায় অবস্থিত। এই মসজিদটির কোন শিলালিপি পাওয়া যায় না। এজন্য মসজিদটির প্রতিষ্ঠাতা ও নির্মাণ কাল সঠিক ভাবে জানা যায় না।
তবে ধারণা করা হয় খান-ই-জাহান আলী ১৫০০ শতাব্দীতে এটি নির্মাণ করেছিলেন, সে হিসাব করলে মসজিদটির বয়স ৬৫০ বা তার কিছু বেশি। এই মসজিদ তৈরিতে যে পাথর ব্যবহার করা হয়েছিলো তা ভারতের ঝাড়খন্ড প্রদেশের রাজমহল থেকে আনা হয়েছিলো। মসজিদের মেঝেতে বিছানো হয়েছিলো নকশা করা ইট।
সুলতানী শাসনকর্তা নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহ এর আমলে খান জাহান আলী খুলনার সুন্দরবনের কোল ঘেষে গড়ে তুলেন খলিফাবাদ রাজ্য। তিনি বৈঠক করার জন্য একটি দরবার প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে এটি ষাট গম্বুজ মসজিদ (sixty dome mosque) হিসাবে পরিচিত লাভ করে।
এই মসজিদটির বাইরে উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ১৬০ ফুট এবং পূর্ব-পশ্চিমে ১৪০ ফুট। মসজিদটির দেয়াল প্রায় ৮.৫ ফুট পুরু। এই মসজিদ টি অর্থোডক্স প্ল্যানে নির্মিত। ধারণা মতে মসজিদটি দেশী এবং তুঘলক নির্মাণ শৈলীর মিশ্রণে বানানো হয়েছে৷ মসজিদটির নাম অনুসারে ধারণা করা হয়, এটি একটি ৬০ গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ৷ আসলে এতে রয়েছে ১১ টি সারিতে বিভিন্ন ধরণের ৭৭ টি গম্বুজ।
যার মধ্যে ৭০ টি গোলাকার৷ ৭টি চার চালা বিশিষ্ট এবং ৪ টি মিনার আছে। মসজিদের ভেতরে ১০ টি মেহরাব আছে। মেহরাব গুলো ৪ টি দক্ষিণ পাশের দেয়ালে এবং ৫ টি উত্তর পাশের দেয়ালে। মাঝখানে আছে বড় আকৃতির মেহরাব৷
ষাট গম্বুজ মসজিদ ১৯১৩ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান হিসাবে স্বীকৃতি পায়। এখানে খান জাহান আলীর নিয়মিত যাতায়াত ছিলো, এই তথ্যটি প্রকাশ করে তৎকালীন আরকিওলজিকাল সার্ভে।
তৎকালীন প্রচলিত ছিলো শাসকরা যেখানে নামাজ আদায় করবেন সেখানে পশ্চিম দরজা থাকার রীতি ছিলো৷ ষাট গম্বুজ মসজিদই (sixty dome mosque) একমাত্র মসজিদ যার পশ্চিম মুখো দরজা আছে।
মসজিদটির সামনে আছে সবুজের সমারোহ এবং পেছনে আছে বিশাল দিঘী। এই মসজিদটিতে এক সাথে ৩ হাজার মুসল্লী নামাজ আদায় করতে পারেন। মহিলাদের নামাজের জন্য আলাদা ব্যবস্থা রাখা আছে।
মসজিদটির নামকরণ
মসজিদ টি যদিও বা ৬০ গম্বুজ নামে পরিচিত। কিন্তু এই নামটি এসেছে বিকৃতির মাধ্যমে৷ এটি ছিলো তখনকার সময়ে খলিফাবাদ শহরের প্রথম ”ছাদ গম্বুজ” বিশিষ্ট মসজিদ। তখন মানুষ এই মসজিদ কে ছাদ গম্বুজ নামেই চিনতো। পরবর্তীতে এই ছাদ গম্বুজ বিকৃত হয়ে ষাট গম্বুজ হয়ে যায়। এবং বর্তমানেও এই নামেই সর্বাধিক পরিচিত৷
কিভাবে যাবেন ষাট গম্বুজ মসজিদ
রাজধানী ঢাকা থেকে এর দুরুত্ব প্রায় ২০৫ কি:মি: এবং বাগেরহাট শহর থেকে মাত্র ৭ কি: মি:
আপনি যদি ঢাকা থেকে ষাট গম্বুজ মসজিদে যেতে চান,তাহলে আপনি বাসে যেতে পারেন। এর জন্য খুব সকালে সায়দাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে প্রায় ৬টা১০ মিনিটে এবং পরবর্তী বাস সন্ধ্যা ৭ টা থেকে রাত ১০ টা পর্যন্ত বেশ কিছু বাস ছেড়ে যায়৷
তার মধ্যে আছে মেঘনা,হামিম ও দোলা,বলেশ্বর,আরা,পর্যটক, বনফুল এ ফাল্গুনী।
এছাড়াও গাবতলি বাস টার্মিনাল থেকে আরো কয়েকটি বাস বাগেরহাটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়৷
ঢাকা বাস টার্মিনাল–—> বাগেরহাট বাস টার্মিনাল—–> (রিকশা নিয়ে) ষাট গম্বুজ মসজিদ। রিকশা ভাড়া ২০ টাকা নেয়।
ঢাকা থেকে বাগেরহাটে বাস ভাড়া জনপ্রতি লাগে ৫৫০-৬৫০ টাকা৷ বাগের হাট বাসস্ট্যান্ড থেকে রিকশা তে ৫০ টাকার কিছু কম ভাড়াতেই ষাট গম্বুজ মসজিদে (sixty dome mosque) যাওয়া যায়। এই মসজিদটি দিনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের মনমুগ্ধকর রুপ নিয়ে হাজির হয়৷ সকাল,দুপুর,রাত কিংবা মধ্যরাত প্রতিটি মুহূর্তেই ভিন্ন রুপে আর্বিভাব হয় দেশের এই সুপ্রাচীন মসজিদ টি।
ষাট গম্বুজ মসজিদ খোলা এবং বন্ধের সময়
ষাট গম্বুজ মসজিদ মূলত একটি মসজিদ, যেটি বাংলাদেশের পর্যটন কেন্দ্রের মধ্যে অন্যতম।
যেটি নামাজ পড়ার জন্য সবসময় ই খোলা থাকে। তবে পর্যটকদের জন্য খোলা এবং বন্ধের নিদিষ্ট সময় সুচী রয়েছে।
গ্রীষ্মকালে—-> সকাল ১০ টা থেকে বিকেল ৬ টা পর্যন্ত খোলা থাকে
শীতকালে—–>সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫ টা পর্যন্ত।
তবে যোহরের নামাজের জন্য ১ ঘন্টা বা তার কিছু বেশি সময় ব্রেক থাকে।
কোথায় থাকবেন
খুলনা বিভাগের বাগেরহাটে অনেক গুলো দর্শনীয় স্থান রয়েছে। সেজন্য বেশ কিছু আবাসিক ও নন আবাসিক হোটেল লেয়ে যাবেন। যদিও বা সেগুলোর মান খুব উন্নত না। মাঝারি মানের হোটেলগুলোর মধ্যে রয়েছে রেল রোডের মমতাজ হোটেল টি।
কিছু সরকারি গেস্টহাউজ রয়েছে৷ আপনার সুবিধা অনুযায়ী যে কোনো হোটেলে থাকতে পারেন। বাগেরহাট থেকে খুলনা প্রায় ১ ঘন্টার পথ। আপনি খুলনা শহরে গিয়েও থাকতে পারেন৷ খুলনাতে রয়েছে অত্যধুনিক সুবিধা সমৃদ্ধ ১০ টি হোটেল।
হোটেল গুলোর সিংগেল ভাড়া (১৫০০-২০০০) হাজারের মধ্য। কাপল রুমের ভাড়া (২২০০-৪০০০) হাজার মত।
আরও পড়ুনঃ কুমিল্লার জেলার দর্শনীয় স্থান
কোথায় খাবেন
হোটেল গুলোতে খাবারের মান খুব বেশী খারাপ নয়। মাঝারি মানের খাবার সেখান কার আবাসিক হোটেল গুলোতে খুব সহজেই পেয়ে যাবেন। দরগার কাছে রাস্তার ধারের হোটেল গুলো থেকে খাবার কিনতে চাইলে খাবার মান এবং দাম জিজ্ঞেস করে নিতে পারেন।
টিকিট খরচ
অসাধারণ সৌন্দর্য এবং প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের স্বরুপ এই ষাট গম্বুজ মসজিদ (shat gombuj mosque)। এজন্য এই মসজিদ টি এক নজর দেখার জন্য প্রতিদিন ভীড় জমায় অনেক দর্শনার্থী।
সময়ের সাথে সাথে মসজিদ প্রাংগনে ঢোকার টিকিটের দাম কিছু কম বেশি হয়ে থাকে। তবে পর্যটক যদি বাংলাদেশী নাগরিক হয় তাহলে তার টিকিটের দাম ১ জনের ২০ টাকা করে৷ বিদেশী পর্যটকের জন্য টিকিটের দাম ১ জনের ২০০ টাকা করে।
আশেপাশে কিছু দর্শনীয় স্থান
বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদের আশেপাশে আরো কিছু দর্শনীয় স্থান রয়েছে। বাগের হাটে গেলে সে স্থান গুলোও দেখে আসতে পারেন৷। এতে করে এক খরচে আপনার অনেক স্থান ঘুরে দেখা হয়ে যাবে৷ দর্শনীয় স্থান গুলোর মধ্যে আছে
- খান জাহান আলীর মাজার, বাগেরহাট জাদুঘরমংলা বন্দর
- নয় গম্বুজ মসজিদ
- বিবি বেগনির মসজিদ
- চুনখোলা মসজিদ
- সিজ্ঞাইর মসজিদ এবং সুন্দরবন।
বি. দ্র: মাজারে সিজদা দেওয়া থেকে বিরত থাকবেন। মুসলিম ধর্মনুযায়ী এটা সুস্পষ্ট শিরক।
শেষকথা
বাংলাদেশের জন্য ষাট গম্বুজ মসজিদ (shat gombuj mosque) একটি অপরুপ সৌন্দর্য একটি নির্দশন। এই সুপ্রাচীন মসজিদ টি দেখার জন্য দেশের গন্ডি পেরিয়ে অনেক বিদেশী পর্যটক আসেন। মসজিদটি যতটুকু সুন্দর তারচেয়ে বেশী ইতিহাস সমৃদ্ধ। এটি নির্মানশৈলী প্রকাশ করে ঐতিহ্যবাহী অতীতের গৌরবগাথা কথা৷।
মধ্যযুগে নির্মিত এই মসজিদটি এখনো অনিন্দ্য সুন্দর। এই সৌন্দর্য উপভোগ করতে আপনাকে বাগেরহাট ভ্রমণ করতে হবে।
আরও পড়ুন –
কুয়াকাটা ভ্রমণ : যাওয়ার উপায়, হোটেল, খরচ, প্ল্যান
বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক (গাজীপুর)