রাজবাড়ী জেলার দর্শনীয় স্থান

রাজবাড়ী জেলার দর্শনীয় স্থান

ঢাকা বিভাগের অন্তর্গত রাজবাড়ী জেলার রয়েছে সমৃদ্ধ ইতিহাস এবং সংস্কৃতি। বৈচিত্র্যময় এই জেলা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ঐতিহাসিক নিদর্শন এবং সুস্বাদু খাবারের জন্য দারুন একটি জায়গা। আজকে আলোচনা করব রাজবাড়ী জেলার দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে।

পদ্মা নদীর তীরে অবস্থিত রাজবাড়ী জেলা ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন, চলনবিল জলাভূমি এবং গোয়ালন্দ জাতীয় উদ্যান সহ বেশ কয়েকটি প্রাকৃতিক আকর্ষণ সমৃদ্ধ। ১৭ শতকের কান্তনগর দুর্গ, ১৮ শতকের আহসান মঞ্জিল এবং ১৯ শতকের গোয়ালন্দ ঘাটসহ রয়েছে অনেক ঐতিহাসিক স্থান রাজবাড়ী জেলায়।

বাউল লোকসংগীত ঐতিহ্য, শাক্ত ধর্মীয় ঐতিহ্য এবং পটচিত্র স্ক্রোল চিত্রকলার ঐতিহ্যসহ বেশ কিছু ঐতিহ্য রয়েছে রাজবাড়ী জেলার। রাজবাড়ী জেলার দর্শনীয় স্থান এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ঐতিহ্যবাহী আউলিয়া মসজিদ, কল্যাণ দিঘি, জামাই পাগলের মাজার, শাহ পাহলোয়ানের মাজার, মীর মোশাররফ হোসেন স্মৃতি কেন্দ্র, নলিয়া জোড় বাংলা মন্দির, দৌলতদিয়া ঘাট, নীলকুঠি, চাঁদ সওদাগরের ঢিবি, সমাধিনগর মঠ, রাজবাড়ী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের লাল ভবন ইত্যাদি। 

আরও পড়ুনঃ চট্টগ্রামের দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ

Table of Contents

মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতিকেন্দ্র  

মহাকাব্যিক উপন্যাস “বিষাদ সিন্ধু” উপন্যাসের রচয়িতা বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেন জন্মগ্রহণ করেন ১৮৪৭ সালের ১৩ই নভেম্বর কুষ্টিয়ার লাহিনীপাড়া গ্রামে তার মামার বাড়িতে। তার পিতা মীর মোয়াজ্জ্বেম হোসেন রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলার নবাবপুর ইউনিয়নের পদমদী গ্রামে বসবাস করতেন।

কথিত আছে, মীর মশাররফ হোসেনের পূর্বপুরুষ সৈয়দ সাদুল্লাহ বাগদাদ থেকে প্রথমে দিল্লী এবং পরবর্তীতে ফরিদপুর জেলার স্যাকরা গ্রামে এসে বসবাস শুরু করেছিলেন। মীর মোশাররফ হোসেনের শিক্ষাজীবন শুরু হয় নিজ গৃহ হতে। এরপর কুষ্টিয়া, ফরিদপুর এবং কৃষ্ণনগরের বিভিন্ন বিদ্যালয়ে। 

তিনি তার জীবনের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গ্রন্থ রচনা করেন পৈতৃক নিবাসেই। মীর মশাররফ হোসেনের মোট গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় ৩৭ টি। জনপ্রিয় এই সাহিত্যিক বিশুদ্ধ বাংলায় একে একে লিখে গেছেন বিভিন্ন কালজয়ী গদ্য, পদ্য, প্রবন্ধ, নাটক এবং উপন্যাস।

“জমিদার দর্পণ” নাটকের জন্য তৎকালীন সময়ে শ্রেষ্ঠ নাট্যকারের মর্যাদা লাভ করেছিলেন। তার রচিত “বিষাদ সিন্ধু” বাংলা সাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। মীর মশাররফ হোসেন পদমদীর নিজ বাসস্থানে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ১৯১১ সালের ১৯ ডিসেম্বর। তার স্ত্রী কুলসুমের সমাধির পাশে তাকে সমাহিত করা হয়। 

মীর মশাররফ হোসেনের স্মৃতি রক্ষার্থে ২০০১ সালের ১৯ এপ্রিল মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতি কেন্দ্রের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০০৫ সালে দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া হয় মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতি কেন্দ্র ( Mir Mosharraf Hossain Memorial Museum)।

বর্তমানে এটি রাজবাড়ী জেলার দর্শনীয় স্থান এর মধ্যে অন্যতম। স্মৃতি কেন্দ্রটিতে আছে প্রায় দেড় হাজার গ্রন্থের একটি সমৃদ্ধ পাঠাগার, দলিল পত্রের সংগ্রহশালা, ১০০ আসন বিশিষ্ট সেমিনার কক্ষ, দফতর,অভ্যর্থনা কক্ষ, অতিথি কক্ষ, কিচেন, ডাইনিং এবং প্রসাধন কক্ষ। 

সময়সূচী : শুক্র এবং শনিবার সহ সকল ধরনের সরকারি ছুটির দিনে বন্ধ থাকে মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতি কেন্দ্র। 

কিভাবে যাবেন 

রাজবাড়ী শহর থেকে মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতি কেন্দ্রে যেতে প্রথমে বালিয়াকান্দি যাবেন বাসে বা অটোতে করে  ( ভাড়া ২৫-৩০ টাকা)। এরপর বালিয়াকান্দি থেকে অটোতে আনন্দবাজার যাবেন ১০ টাকা ভাড়ায়। আনন্দ বাজার থেকে রিক্সা বা ভ্যান নিয়ে (ভাড়া ৫ টাকা) এক কিলোমিটার পূর্ব দিকে এগিয়ে গেলেই দেখতে পাবেন মীর মশাররফ হোসেন স্মৃতি কেন্দ্র। 

রাজবাড়ী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের লাল ভবন 

ঐতিহাসিক রাজবাড়ী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের লাল ভবন রাজবাড়ী জেলার দর্শনীয় স্থান এর মধ্যে অন্যতম। প্রাচীন এই স্থাপনার বয়স প্রায় দেড়শত বছর। এই ভবনটিকে কাঁচারী ঘর হিসেবে ব্যবহার করতেন গোয়ালন্দ মহকুমার বাণীবহ এস্টেট এর বাণীবহের জমিদার গিরিজা শংকর মজুমদার। জমিদার গিরিজা শংকর মজুমদার ১৮৯২ সালে এই লাল ভবনকে গোয়ালন্দ মডেল হাই স্কুল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন।  

বিভিন্ন তথ্য অনুযায়ী, ১৮৭১ সালে মাইনর স্কুলের মাধ্যমে শুরু হওয়া এই প্রতিষ্ঠান ১৮৯২ সালে পূর্ণরুপ লাভ করে। জমিদার গিরিজা শংকর মজুমদার এবং অভয় সংকর মজুমদার ১৮৯২ সালে “দি গোয়ালন্দ ইংলিশ হাই স্কুল” নামে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে বিদ্যালয়টির নাম পরিবর্তন করে “গোয়ালন্দ মডেল হাই স্কুল” রাখা হয় । এটি বর্তমানে রাজবাড়ী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় নামে পরিচিত। 

কিভাবে যাবেন 

রাজবাড়ী জেলা সদরের যেকোনো জায়গা থেকে রিক্সা বা অটো রিক্সা নিয়ে যেতে পারবেন রাজবাড়ী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের লাল ভবন দেখতে। 

রাজবাড়ী জেলার দর্শনীয় স্থান- জামাই পাগলের মাজার 

জামাই পাগলের মাজার রাজবাড়ী সদর উপজেলার আলিপুর ইউনিয়নের ০৩ নং ওয়ার্ডভুক্ত আলাদিপুর গ্রামে অবস্থিত। ধারণামতে, নেংটি পরিহিত এক ব্যক্তি ১৯৬০ সালের দিকে বর্তমান মাজার প্রাঙ্গণে শেওরা গাছের নিচে অবস্থান নেন। সেই ব্যক্তির নামে বিভিন্ন অলৌকিক ঘটনা প্রচলিত আছে। লোকমুখে শোনা যায়, পাবনা জেলার এক ধনী ব্যক্তি এক পাগলের সাথে তার বোবা মেয়েকে দিয়ে দেন।

বিয়ের রাত শেষ হতেই বোবা মেয়েটি কথা বলা শুরু করে। কিন্তু সেই পাগল জামাইকে কোথাও আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। অবশেষে রাজবাড়ী জেলার আলাদিপুর গ্রামে তাকে খুঁজে পাওয়া গেলেও আর সংসারে ফিরে যাননি। ঘটনাটি ঘটার পর থেকে জামাই পাগল নাম সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। 

কথিত আছে, আলাদিপুর গ্রামে যখন জামাই পাগল আসেন তখন সেই গ্রামের অনেক মানুষ কলেরা আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছিল। সেই সময় জামাই পাগল সকলকে সারিয়ে তোলেন। এরপর থেকে মানুষজন বিভিন্ন বিপদ মুক্তির আর্জি নিয়ে তার কাছে আসতে শুরু করেন। তাকে যদি কেউ কিছু বলত, তিনি একই কথার পুনরাবৃত্তি করতেন এবং সেই উসিলায় মানুষের সমস্যার সমাধান হয়ে যেত।

তার মৃত্যুর পর এক আগন্তুক সৎকারের সমস্ত ব্যবস্থা করেন এবং সেখানে একটি মাজার গড়ে তোলা হয়। এই মাজারটি রাজবাড়ী জেলার দর্শনীয় স্থান এর মধ্যে পরে। নুর বাকের শাহ নামের এক ভক্ত এরপর ওইখানে অবস্থান নেন। নুর বাকের শাহ এর মৃত্যুর পর মাজারটি দেখাশোনা করতেন গৌরী পাগলী।

জামাই পাগল মাজারের ভিতর মুর্শিদ জামাই পাগল, নূর বাকের শাহ এবং গৌরী পাগলীর পৃথক কবর আছে। প্রতিবছর ১৫ ই ফাল্গুন এবং ৩১ ফাল্গুন দুইটি বড় ঔরসসহ জামাই পাগল মাজারে সর্বমোট পাঁচটি ঔরস অনুষ্ঠিত হয়। 

কিভাবে যাবেন

জামাই পাগলের মাজার রাজবাড়ী জেলা সদর থেকে মাত্র ৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। রাজবাড়ী জেলা সদর থেকে রিকশা বা ইজিবাইক নিয়ে খুব সহজেই যেতে পারবেন জামাই পাগল মাজারে। 

রাজবাড়ী জেলার দর্শনীয় স্থান – কল্যাণ দিঘি 

কল্যাণদিঘি অবস্থিত রাজবাড়ী জেলার নবাবপুর ইউনিয়নের অন্তর্গত রাজধরপুর গ্রামের পাশে। কল্যান দিঘি রাজবাড়ী জেলার দর্শনীয় স্থান। বিশালাকার দিঘিটি বর্তমানে সমতল বিলে পরিণত হলেও এর আয়তন স্পষ্টই বুঝতে পারা যায়। ১৬ খাদা জমি নিয়ে এত বিশাল আকারের দিঘি এ অঞ্চলে বিরল। কথিত আছে, অষ্টাদশ শতকে রাজা সীতারাম কল্যাণ দিঘি খনন করেন।

রাম সাগর, সুখ সাগর এবং কৃষ্ণ সাগর দিঘিগুলো রাজা সীতারাম খনন করেছিলেন বলে জানা যায়। অনেকের মতে, রাজা সীতারামের ২০০ জন সৈন্যের এক বাহিনী ছিল। এই বাহিনীর সৈন্যেরা যুদ্ধের সময় ব্যতীত মানুষের পানির কষ্ট দূর করার জন্য জলাশয় খনন করতেন। লোকমুখে প্রচলিত আছে, রাজা সীতারাম প্রতিদিন নতুন খননকৃত জলাশয়ে স্নান করতেন। 

তবে অনেকেই আবার মনে করেন, খান জাহান আলী কর্তৃক কল্যাণদিঘি খননকৃত। খান জাহান আলী যশোর এবং খুলনা অঞ্চল ১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দে জয় করে খলিফাতাবাদ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার জনহিতকর কাজের অংশ হিসেবে অসংখ্য দিঘি খনন করা হয়। ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে খান জাহান আলী একদল ধর্ম প্রচারককে উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রেরণ করেছিলেন এবং তাদের দ্বারা কল্যাণ দিঘি খনন করা হয়েছে মনে করা হয়। 

কিভাবে যাবেন

রাজবাড়ী থেকে ইজিবাইক বা নসিমনে করে কল্যাণদিঘি যেতে পারবেন। 

নলিয়া জোড় বাংলা মন্দির 

রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলার জামালপুর ইউনিয়নের নলিয়া গ্রামে জোড় বাংলা মন্দির অবস্থিত। পাশাপাশি দুটি মন্দির হওয়ায় একে জোড় বাংলা মন্দির বলে। মন্দির দুটির একটিতে চূড়া থাকলেও অপরটিতে চূড়া অবশিষ্ট নেই।

রাজা সীতারাম রায় ১৬৫৫ সালে উড়িষ্যার গৌড়ীয় রীতিতে এই জোড় বাংলা মন্দির এবং বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে শ্রীকৃষ্ণ রাম চক্রবর্তী রাজা সীতারাম রায়ের অনুরোধে নলিয়া গ্রামে আসেন এবং দেব মন্দির ও বিগ্রহ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেন। বর্তমানে জোড় বাংলা মন্দির রাজবাড়ী জেলার দর্শনীয় স্থান।

কিভাবে যাবেন

প্রথমে রাজবাড়ী জেলা সদর থেকে বালিয়াকান্দি বাসস্ট্যান্ডে নামবেন। বালিয়াকান্দি বাসস্ট্যান্ড থেকে ইজিবাইক, বাস বা নসিমনে চড়ে যেতে পারবেন নলিয়া গ্রামে অবস্থিত জোড় বাংলা মন্দিরে।

আরও পড়ুনঃ লালবাগ কেল্লা (পুরান ঢাকার) ভ্রমন

শাহ পাহলোয়ানের মাজার

শাহ পাহলোয়ানের মত আউলিয়ারা ধর্ম প্রচারের জন্য রাজবাড়ী অঞ্চলে আগমন করেন ষোড়শ শতকে। ১৪৮০ থেকে ১৫১০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বোগদাদ শরীফ পরিত্যাগ করে শাহ পাহলোয়ান ফরিদপুর অঞ্চলে এসে চন্দনা নদীর তীরে বাসস্থান নির্মাণ করে উপাসনা করছিলেন। জানা যায়, তার মৃত্যুর সময় শিষ্যরা তার কবর পূর্ব-পশ্চিম লম্বালম্বি দিতে বলেছিলেন।

এর কারণ হচ্ছে, তার পীর খান জাহান আলী সেকাড়া থেকে দক্ষিণে অবস্থান করছিলেন। পীর খান জাহান আলীর রওজা সেকাড়া গ্রামে বিদ্যমান। কিন্তু প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী তার শিষ্যবর্গ যথানিয়মে তাকে কবরস্থ করেন। কিন্তু সকালে দেখা গেল কবর ঘুরে পূর্ব-পশ্চিম লম্বালম্বি হয়ে গিয়েছিল। এটি রাজবাড়ী জেলার দর্শনীয় স্থান এর মধ্যে একটি। 

রাজবাড়ী জেলার দর্শনীয় স্থান – নীলকুঠি 

সিপাহী বিদ্রোহের পর (১৮৫৭ সালে) নীলকরদের অত্যাচার আরো বৃদ্ধি পায়। ফলে সাধারণ প্রজারা অতিষ্ঠ হয়ে সঙ্ঘবদ্ধভাবে নীলকরদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। শুরু হয়ে যায় নীলবিদ্রোহ। রাজবাড়ীতে সংঘটিত হয় নীলবিদ্রোহ। ওই সময় বালিয়াকান্দি থানার সোনাপুরের হাসেম আলীর নেতৃত্বে শত শত চাষী নীলকর এবং জমিদারদের বিরুদ্ধে নীলবিদ্রোহে অংশগ্রহণ করে। অনেক স্থানে নীলকুঠি আক্রমণ করে এবং কাচারি জ্বালিয়ে দেয়। 

রাজবাড়ী অঞ্চলের বসন্তপুর, বহরপুর, সোনাপুর, বালিয়াকান্দি, নাড়ুয়া, মদাপুর, মৃগী, সংগ্রামপুর, পাংশার নীল চাষীরা বিদ্রোহী হয়ে ওঠে। এর ফলশ্রুতিতে ১৮৬০ সালে ব্রিটিশ সরকার নীল কমিশন বসান এবং নীল চাষ স্বেচ্ছাধীন ঘোষণা করেন । এরপর আস্তে আস্তে কৃত্রিম নীল উদ্ভাবিত হয় এবং প্রাকৃতিক নীল চাষ বন্ধ হয়ে যায়। রাজবাড়ীতে এখনো নীলকুঠি রয়েছে।

গোদার বাজার ঘাট 

রাজবাড়ী সদর উপজেলা থেকে প্রায় ৩.৫ কিলোমিটার দূরে পদ্মা নদীর তীরে অবস্থিত গোদার বাজার ঘাট। ঐতিহ্যবাহী গোদার বাজার ঘাট রাজবাড়ী জেলার দর্শনীয় স্থান এর মধ্যে অন্যতম। এই ঘাট দিয়ে নদী পথের মাধ্যমে মালামাল আমদানি-রপ্তানি হয়ে থাকে । প্রত্যেক বছর আশ্বিন মাসে এখানে অনুষ্ঠিত হয় বিশাল নৌকা বাইচ। এই স্থানটি দর্শনার্থীদের মিলনমেলায় পরিণত হয় প্রতিদিন বিকেলে। 

রাজবাড়ী জেলার দর্শনীয় স্থান – দৌলতদিয়া ঘাট 

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল ( যশোর, ফরিদপুর, খুলনা, কুষ্টিয়া, বরিশাল) পদ্মা নদী দ্বারা বিভক্ত। ঢাকা থেকে দক্ষিণাঞ্চলের এসব জেলায় পৌঁছানোর জন্য দৌলতদিয়া ঘাট অতিক্রম করা অপরিহার্য ছিল। ব্রিটিশ ভারতে গোয়ালন্দ বাংলার পশ্চিম এবং পূর্বের সেতু বন্ধন হিসেবে বাংলার দার নামে পরিচিত ছিল।

গোয়ালন্দকে ব্রিটিশ আমলে বলা হত “গেটওয়ে অব বেঙ্গল”। দৌলতদিয়া ঘাট নামে পরিচিত লঞ্চ ঘাটটি। বাংলাদেশের দুটি বড় নদী পদ্মা এবং যমুনার মিলন ঘটেছে এখানে। সে আমলে পদ্মার ইলিশের জন্যও জায়গাটি বিখ্যাত ছিল। 

রথখোলা স্নানমঞ্চ 

রাজবাড়ী শহর থেকে দুই স্টেশন পশ্চিমে প্রাচীন হড়াই নদীর তীরে বেলগাছি একটি ঐতিহাসিক স্থান। বেলগাছির অদূরে হাড়োয়াতে কষ্টিপাথরের মদন মোহন জিওর স্থাপনা করা হয়েছে। মদন মোহনের মূর্তিটি পাল আমলের সাক্ষী। রাম জীবনের নামে বেলগাছিতে গড়ে ওঠে আখড়া। তার স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে সেখানে স্নানমঞ্চ এবং দোলমঞ্চের ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। 

দাদ্শী মাজার শরীফ 

রাজবাড়ী শহর থেকে রেললাইন ধরে পূর্ব দিকে ১ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত দাদ্শী খোদাই দরগা। কামাল শাহ নামক এক আউলিয়া ইসলাম প্রচার করার উদ্দেশ্যে ষোড়শ শতকে এই অঞ্চলে আগমন করেন। ১৮৯০ সালে গোয়ালন্দ ঘাট পর্যন্ত রাজবাড়ী রেললাইন স্থাপন করার সময় জঙ্গলের মধ্যে এই দরগার সন্ধান পাওয়া যায়। তখন থেকেই দরগাটি ওই অঞ্চলের মানুষ খোদাই দরগা নামে কামাল শাহ আউলিয়ার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে আসছেন। 

সমাধিনগর মঠ (অনাদি আশ্রম) 

রাজবাড়ী জেলার বালিয়াকান্দি উপজেলার জঙ্গল ইউনিয়নে স্বামী সমাধি প্রকাশরণ্য ১৯৪০ সালে সমাধিনগর মঠ নির্মাণ করেন। এই মঠের উচ্চতা ৭০ ফুট (গম্বুজসহ), দৈর্ঘ্য প্রায় ৮০ ফুট ও প্রস্থ ৫০ ফুট । এটি “অনাদি আশ্রম” নামে পরিচিত। স্বামীজী এই আশ্রম এর মাধ্যমে ওই এলাকার মানুষদেরকে আলোর পথে অগ্রায়ন করে গেছেন। 

কিভাবে যাবেন রাজবাড়ী

ঢাকা থেকে রাজবাড়ী যেতে হলে সাধারণত সড়ক পথেই যেতে হবে। সড়কপথে যেতে সময় লাগবে তিন থেকে চার ঘন্টা। তবে ফেরি পারাপার করার সময় যানজট থাকলে সময় আরো বেশি সময় লাগতে পারে। রাজধানীর গাবতলী বাস স্ট্যান্ড থেকে বেশ কয়েকটি বাস রাজবাড়ির উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। বাসগুলোর মধ্যে আনন্দ পরিবহন, আজমিরী পরিবহন, স্কাই লাইন, রাজবাড়ী এক্সপ্রেস উল্লেখযোগ্য। ভাড়া ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। 

কোথায় থাকবেন 

রাজবাড়ী জেলায় রয়েছে কয়েকটি সরকারি ডাক বাংলো এবং বেশ কয়েকটি আবাসিক হোটেল। উল্লেখযোগ্য হোটেল – হোটেল গ্র্যান্ড প্যালেস, হোটেল সমবায় রেসিডেন্সিয়াল, হোটেল পার্ক, হোটেল গোল্ডেন, গুলশান বোডিং, প্রাইম হোটেল, হোটেল ৭১ এন্ড রিসোর্ট ইত্যাদি । 

যোগাযোগ

  • হোটেল পার্ক (রাজবাড়ী পৌরসভা রোড, রাজবাড়ী) : ০৬৪১-৬৬১১১
  • হোটেল ৭১ এন্ড রিসোর্ট (রাজবাড়ী পৌরসভা রোড, রাজবাড়ী) : ০১৭৬৩-৭৭৩৮৭১

কোথায় খাবেন 

প্রয়োজনীয় খাবারের চাহিদা মেটানোর জন্য রাজবাড়িতে রয়েছে বিভিন্ন মানের হোটেল এবং রেস্টুরেন্ট। পান বাজারে অবস্থিত ভাদু শাহার দোকানের চমচম, ঝালাই পট্টির কুলফি মালাই, রেলগেটের হৈরা শাহের চপ রাজবাড়ীর অধিক জনপ্রিয় খাবার। 

শেষকথা

আশা করছি উপরের আলোচনা থেকে রাজবাড়ী জেলার দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে ধারণা পেরেছেন। রাজবাড়ী বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চলের একটি জেলা। পদ্মা এবং যমুনা নদীর অববাহিকায় এই জেলার অবস্থান। নদীর জেলা বললে ভুল হবেনা রাজবাড়ীকে। রাজবাড়ী জেলাকে ঘিরে পদ্মা, চন্দনা, গড়াই নদী এবং হড়াই নদী বহমান। রাজা সূর্যকুমারের বাড়ির নাম অনুসারে এই জেলার নামকরণ করা হয়েছে। রাজবাড়ীকে জেলা হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয় ১৯৮৪ সালের পহেলা মার্চ।

এই জেলায় রয়েছে বেশ কয়েকটি দর্শনীয় স্থান, যা উপরে আলোচনা করা হয়েছে। অনেক দর্শনার্থীরা এসব দর্শনীয় স্থানগুলোতে ভ্রমণ করেন। আপনাদেরকে স্বাগতম রাজবাড়ী জেলার দর্শনীয় স্থানগুলো ভ্রমণ করার জন্য। দর্শনীয় স্থানগুলো আমাদের দেশের ঐতিহ্য, আমাদের দেশের গর্ব। তাই এগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করা আমাদেরই দায়িত্ব। 

রাজবাড়ী জেলার দর্শনীয় স্থান সম্পর্কিত প্রশ্ন এবং উত্তর / FAQ’s

১. রাজবাড়ী জেলার বিখ্যাত কি কি?

উত্তর : রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলা লেবু চাষের জন্য বিখ্যাত। চমচম মিষ্টির জন্য ও রাজবাড়ী বিখ্যাত। রাজবাড়ী জেলা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯৮৪ সালের ১ মার্চ। 

২. মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজবাড়ী জেলা কত নম্বর সেক্টরের অধীনে ছিল?

উত্তর : ১৮ ডিসেম্বর হানাদার মুক্ত হয় রাজবাড়ী জেলা। সাবেক রাজবাড়ী জেলা ইউনিট কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল হোসেন বলেন, রাজবাড়ীতে যুদ্ধ হয় ৮ নম্বর সেক্টরের অধীনে এবং রাজবাড়ী শহর ছিল অবাঙালি বিহারি অধ্যুষিত অঞ্চল।

৩. বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ফেরিঘাট কোথায় অবস্থিত? 

উত্তর : বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ফেরিঘাট রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দ ঘাটে অবস্থিত। 

৪. রাজবাড়ী জেলার বিখ্যাত খাবারগুলো কি? 

উত্তর : পান বাজারে অবস্থিত ভাদু শাহার দোকানের চমচম, ঝালাই পট্টির কুলফি মালাই, রেলগেটের হৈরা শাহের চপ রাজবাড়ী জেলার জনপ্রিয় এবং বিখ্যাত খাবার। 

আরও পড়ুন-

লালন শাহ মাজার

ম্যাজিক প্যারাডাইস পার্ক কুমিল্লা

মন্তব্য করুন