মহেরা জমিদার বাড়ি
জমিদার বাড়ি কে না দেখতে পছন্দ করে। আর প্রকৃতির অনিন্দ্য নিকেতন হলো মহেরা জমিদার বাড়ি (mohera jomidar bari)। এটি বাংলাদেশের টাঙ্গাইল জেলায় সদর থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরে আট একর জায়গা জুড়ে মহেড়া জমিদার বাড়ি অবস্থিত। বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর জমিদার বাড়ি এর মধ্যে মহেরা জমিদার বাড়ি হলো অন্যতম একটি।
মহেরা জমিদার বাড়ি ভ্রমণ কেমন হবে বলুন তো? বাংলাদেশের ঢাকা, গাজীপুর, ময়মনসিংহ জেলার বেশিরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অথবা অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠান তাদের বার্ষিক পিকনিকের আয়োজনে স্পট হিসেবে এই বিখ্যাত মহেরা জমিদার বাড়িকেই সবথেকে বেশি প্রাধান্য দিয়ে থাকে।
টাঙ্গাইলে যদি ঘুরতে আসেন, আর মহেরা জমিদার বাড়ি যদি দর্শন না করে চলে যান, তাহলে আপনি কিন্তু অনেক বড় একটি সুযোগ মিস করে ফেলবেন। টাঙ্গাইলে ছোট বড় মিলিয়ে অনেক জমিদার বাড়ি থাকলেও মহেরা জমিদার বাড়িটিই কিন্তু সবগুলোর থেকে অনেক বেশি আকর্ষণীয়, দৃষ্টিনন্দন ও সুন্দর।
আজকের আর্টিকেলে আমি মহেরা জমিদার বাড়ির (mohera jomidar bari) ইতিহাস, মহেড়া জমিদার বাড়িতে কী কী আছে, কিভাবে যাবেন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করব। তাহলে চলুন দেরি না করে যেনে নেওয়া যাক- বিস্তারিত সকল কিছু।
আরও পড়ুনঃ সাজেক রিসোর্ট লিস্ট ও সকল তথ্য
মহেরা জমিদার বাড়ির ইতিহাস
ইতিহাস ঘাটলে জানা যায় যে, ১৮৯০ দশকের পূর্বে এই জমিদার বাড়ীটির পত্তন ঘটে। কালীচরণ সাহা ও আনন্দ সাহা নামের দুই ভাই কলকাতায় লবণ ও ডালের ব্যবসা করে নাকি প্রচুর টাকা পয়সা রোজগার করে। এবং তারা দুই ভাই চলে আসেন মহেড়া গ্রামে। মহেড়া গ্রামে তারা প্রায় ১ হাজার ১৭৪ শতাংশ জমির ওপরে এই সুবিশাল বাড়িটি নির্মাণ করেন। আর মহেড়া গ্রামের নাম অনুসারেই এই বাড়ির নাম রাখা হয়(mohera jomidar bari) মহেরা জমিদার বাড়ি।
এবং বাড়ি নির্মাণ করার পর তারা দুই ভাই মহেড়া গ্রামের গরিব মানুষের কাছে টাকা দান খাটাতে থাকেন এবং এলাকার প্রভুত অনেক উন্নতি করেন। পরে ব্রিটিশ সরকার বাংলা শাসন করতে আসলে তারা জমিদার প্রথা চালু করে। এবং এই প্রথা চালু করলে কালীচরণ সাহা ও আনন্দ সাহার ছেলেরা করটিয়ার ২৪ পরগনার জমিদারদের কাছে থেকে একটি অংশ বিপুল টাকার বিনিময়ে কিনে নেয়।
আর তারপর শুরু হয় জমিদারি। কালীচরণ সাহা ও আনন্দ মোহন সাহার উত্তরাধিকারী রাজেন্দ্র রায় চৌধুরী পর্যায়ক্রমে এই জমিদারি পরিচালনা করে থাকেন। এবং এই জমিদারি আমলের শাসকরা এলাকায় বিদ্যালয়, রাস্তাঘাট, পানির ব্যবস্থাসহ অনেক জনকল্যাণমূলক কাজও করেন। শুধু জমিদার তরফের সন্তানেরাই এই বিশাল বিত্ত বৈভবের মালিক ছিলেন না।
বরং তাদের ছিল সুবিশাল চিত্তও। তারা এলাকার মানুষের সামগ্রিক কল্যাণের কথা চিন্তা করেই এসব বিদ্যালয়, মন্দিরসহ নানাবিধ প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করেছিলেন। ১৮৯০ সালের দিকে মহেড়া আনন্দ উচ্চ বিদ্যালয়টি জমিদার বাড়ীর আনন্দ কুমার রায় চৌধুরীর নামে প্রতিষ্ঠিত করা হয়।
মহেরা জমিদার বাড়ি যাওয়ার উপায়
মহেরা জমিদার বাড়ি দেখতে হলে আগে আসতে হবে ঢাকায়। তারপর ঢাকার মহাখালী বাস স্টেশন থেকে বিনিময়, নিরালা, ধলেশ্বরী, ঝটিকা ইত্যাদি বাসে করে চলে আসবেন টাঙ্গাইল। আর এসব বাসে জনপ্রতি ভাড়া হবে ১২০ থেকে ১৬০ টাকা। এসব বাস গুলোতে চড়ে নাটিয়াপাড়া বাসষ্ট্যান্ডে নেমে যাবেন। এখানে দেখবেন অপেক্ষ্যমান অনেক সিএনজি ও বেবীটেক্সী। এবার সিএনজি যোগে করে চলে আসুন ০৩ কিঃমিঃ পূর্ব দিকে। আর এখানেই মহেড়া জমিদার বাড়ি।
মহাসড়কে পুলিশ ট্রেনিং সেন্টার, মহেড়া, টাঙ্গাইল নামের দিক নির্দেশনা দিয়ে বিশাল এক সাইনবোর্ড আছে। আর যারা উত্তরবঙ্গ থেকে আসতে চান তারা যে কোন ঢাকাগামী বাসে করেই সরাসরি টাঙ্গাইল পার হয়ে ১৭ কিঃমিঃ পরে নাটিয়াপাড়া বাসষ্ট্যান্ডে নেমে একইভাবে যেতে পারবেন।
আপনি চাইলে উত্তরবঙ্গ থেকে ঢাকাগামী যেকোনো বাসে উঠেই ‘নাটিয়াপাড়া বাজার’ নামতে পারেন। নাটিয়াপাড়া বাজার থেকে আবারমহেরা জমিদার বাড়ি দূরত্ব পরবে প্রায় ৪ কিলোমিটার। আর এই নাটিয়াপাড়া বাজার থেকে সি.এন.জি. পাওয়া যায় (mohera jomidar bari)মহেড়া জমিদার বাড়ি যাওয়ার জন্য।
মহেরা জমিদার বাড়ি যা দেখবেন
জমিদার বাড়িটি মূলত টাঙ্গাইল সদর থেকে প্রায় ১৮ মাইল পূর্বে ও ১০ কিলোমিটার পশ্চিমে আট একর জমি জুড়ে বিস্তৃত। এই মহেরা জমিদার বাড়িটি হলো সভ্যতা আর ঐতিহ্যের এক অমূল্য নিদর্শন। এটি এখনো এতো সুন্দর ও সযত্নে সংরক্ষিত আছে যা দেখলে মনে হবে নতুন তৈরী হয়েছে।
আর এই জমিদারবাড়ির মতো এদেশে দ্বিতীয়টি নেই বললেই চলে। এটিকে বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর জমিদার বাড়ি বলা যায়। মহেড়া জমিদার বাড়িতে ঘুরতে আসলে দেখতে পারবেন ছোট পার্ক, চিড়িয়াখানা, বোট রাইড আর অনেক সুন্দর পিকনিক স্পটও। এবার আসি মূল বাড়িতে।
মহেরা জমিদার বাড়ির(mohera jomidar bari) প্রধান ফটক দুটি। প্রধান দুটি ফটক ছাড়াও এই জমিদারবাড়িতে রয়েছে বিশাল তিনটি প্রধান ভবন। এগুলো সঙ্গে রয়েছে কাছারিঘর, নায়েব সাহেবের ঘর, গোমস্তাদের ঘর, দীঘি আর তিনটি লজও। এবং মূল ভবনের সামনেই আছে বিশাল এক দীঘি। এর নাম হলো বিশাখা সাগর।
তাছাড়া তিনটি ভবন এর পিছনেই আছে পাসরা পুকুর এবং রানী পুকুর নামের দুইটা পুকুরও। আরও আছে কাছারি বাড়ি। আরও আছে আত্মীয় স্বজন কর্মচারীদের থাকার মত বাড়ী এবং প্রার্থনার জন্য রয়েছে বিভিন্ন দেব দেবির মন্দির। মহেড়া জমিদার বাড়িতে প্রবেশের জন্য রয়েছে ২টি সুরম্য গেটও।
আর যে তিনটি ভবনের কথা বললাল এই ভবন গুলোর সামনেই দেখতে পারবেন সুন্দর ফুলের বাগান। ভবন গুলো আর বিশাখা সাগর এর মাঝখানেই আছে রাস্তা,আর সেই রাস্তার পাশে আছে কয়েকটা উচু গোল কারুকার্যময় স্তম্ভ।
তাছাড়া কালীচরণ লজ-এর সামনেই আবার বেশ বড় একটা খোলা যায়গা বা মাঠ আছে। এখানকার তিনটি দৃষ্টিনন্দন লজ দেখা শেষ হতেই পাসরা ও রানি পুকুর পারেই আপনি চাইলে খানিকটা বিশ্রাম নিতে পারেন।
তাছাড়া এই পুকুরের পাশেই আবার আছে রঙিন মাছে ভরা অ্যাকুরিয়াম। এখানে আরও আছে লোহার তৈরি টেবিল ও চেয়ারসমূহ। পুরো বাড়িতেই পুলিশ ট্রেনিং একাডেমির কার্যক্রম চলে থাকে, তাই এখানে অনুমতি নিয়ে প্রবেশ করতে হয়।
আরও পড়ুনঃ রাজবাড়ী জেলার দর্শনীয় স্থান
মহেরা জমিদার বাড়ি প্রবেশ টিকিট মূল্য
এখানে শীতের মৌসুমে হাজারো ফুলের মেলা দেখতে পাওয়া যায়। অপরুপ সাঁজে সাজানো এই জমিদার বাড়িতে প্রায় প্রতিদিনই চলে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ওপ্রতিষ্ঠানের পিকনিক এবং চলে বিভিন্ন নাটক বা ছবির শুটিং। আর তাই ব্যবস্থাপনার স্বার্থে এখানে প্রবেশের শুভেচ্ছা মূল্য হলো মাত্র ৮০ টাকা। আর পিকনিক বা শুটিং স্পট ভাড়া দেওয়া হয় আলোচনা করে।
আর কেউ যদি বোট রাইডে চড়তে চায় তাহলে দরদাম সেখানে করে নেবেন।
কি খাবেন ও কোথায় থাকবেন
নিশ্চয়ই ভাবছেন, ঘুরতে যাবেন কিন্তু থাকবেন কোথায়? কিই বা খাবেন। চিন্তা নেই! সেখানে আছে খাবার ও পানীয়ের জন্য আছে স্বল্প মূল্যের ক্যান্টিন সুবিধা। আপনি যদি আগেই অর্ডার দেন তাহলে আপনার পছন্দের মেনু অনুযায়ী যে কোন খাবার পেয়ে যাবেন। তাছাড়াও আশে পাশে অনেক খাবারের দোকান আছে।
আপনি যদি এই জমিদার বাড়িতে পূর্ণিমা স্নান বা রাত্রীযাপন করতে চান তার জন্যও আছে সুব্যবস্থা। এখানে আছে এসি/নন এসি ডাক বাংলোর মতো ব্যবস্থা। তাছাড়া আপনি চাইলে টাঙ্গাইল শহরের যেকোনো একটি নিম্ন বা মধ্যমানের হোটেলেও উঠতে পারবেন। এবং সেখান থেকে সিএনজিতে করে জমিদার বাড়ি যেতে পারবেন। হোটেলগুলোতে দুপুর এবং রাতের খাবারের ব্যবস্থাও আছে।
শেষ কথা
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালের দিকে এই পরিত্যাক্ত জমিদার বাড়ীটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে পুলিশ ট্রেনিং স্কুল হিসেবে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব আব্দুল মান্নান। তারপর পুলিশের প্রশিক্ষণকে আধুনিক এবং যুগোপোযোগী করার লক্ষ্যেই ১৯৯০ সাল থেকে এই পুলিশ ট্রেনিং স্কুলকে পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারে উন্নীত করা হয়।
আর পুলিশের ট্রেনিং সেন্টার স্থাপন হওয়ায় ট্রেনিং পরিচালনার সুবিধার্থে জমিদার বাড়ীটিকে যথাযথ রক্ষনাবেক্ষণসহ আরও নতুন নতুন স্থাপনা তৈরী করা হয়। আর এ কারণেই জমিদার বাড়িটিকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সবচেয়ে সুন্দর জমিদার বাড়ি বলাই যেতে পারে।
তাই পূর্ব ইতিহাসকে জানতে এবং সৌন্দর্য দ্বারা নিজের মনকে প্রফুল্ল রাখতে আজই চলে আসুন মহেরা জমিদার বাড়ি তে।
মহেরা জমিদার বাড়ি নিয়ে কিছু প্রশ্ন অ উত্তরঃ
১ / মহেড়া জমিদার বাড়ী কিভাবে যাব?
উত্তরঃ- বাস বা রেল যোগে আগে টাঙ্গাইল শহরে পৌঁছাতে হবে এবং পরে নাটিয়াপাড়ার বাস ধরে পৌঁছে যাবেন মহেরা জমিদার বাড়ি।
২/ টাঙ্গাইলের সব জমিদার বাড়ি এর নামের তালিকা জানতে চাই?
উত্তরঃ- করটিয়া জমিদার বাড়ী, মহেড়া জমিদার বাড়ী, পাকুল্লা জমিদার বাড়ী, দেলদুয়ার জমিদার বাড়ী, নাগরপুর জমিদারবাড়ী
৩/ মহেড়া জমিদার বাড়ী সাপ্তাহিক বন্ধ কবে থাকে?
উত্তরঃ- প্রতিদিনই প্রায় খোলা থাকে।
৪/ মহেড়া জমিদার বাড়ী কোথায় অবস্থিত?
উত্তরঃ- টাঙ্গাইল শহরে অবস্থিত।
আরও পড়ুন-
বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘর, ঢাকা
কুমিল্লার জেলার দর্শনীয় স্থান