মাদারীপুরের দর্শনীয় স্থান
দর্শনীয় স্থানের দিক দিয়ে ঢাকা বিভাগে মাদারীপুর জেলা (madaripur) হলো অন্যতম। বাংলাদেশের প্রশাসনিক জেলা হিসাবে এই মাদারীপুরের জন্ম হয় পঞ্চদশ শতাব্দীতে। এই জেলার নামকরণ করা হয় সুফি সাধক কুতুবি জাহান হযরত বদিউদ্দিন আহমেদ জিন্দাশাহ মাদার রহঃ।
তিনি সিরিয়া থেকে মাদারীপুরে ধর্ম প্রচার করতে আসেন। মাদারীপুরের দর্শনীয় স্থান মধ্যে অন্যতম হলো ঝাউদি গিরি, আওলিয়াপুর নীলকুঠি, বাজিতপুরের প্রণবমঠ, খালিয়া শান্তিকেন্দ্র, পর্বতের বাগান, শকুনি লেক ইত্যাদি।
আরও পড়ুনঃ নীলগিরি বান্দরবান
ঝাউদি গিরি
মাদারীপুরের দর্শনীয় স্থানগুলির মধ্যে ঝাউদি গিরি অন্যতম। এটি হলো মাদারীপুরের (madaripur) একটি ব্যতিক্রমী স্থাপনা। যদিও বছরের পর বছর এটির যত্ন না নেওয়ার কারণে আজ তা ধ্বংসের মুখে পড়েছে। বলা হয়ে থাকে এটি ৩০০ বছর আগে স্থাপিত হয়েছিল। এটির উচ্চতা প্রায় ৬০ ফুট। তবে কে বা কারা এটি তৈরি করেছিল তা এখনো জানা যায়নি।
তবে অনেকেই মনে করেন এটি নবাব আলিবর্দী খাঁ নির্মান করে ছিলেন। আবার অনেকেই মনে করেন এটি মগরাই নির্মান করেছিলেন। সপ্তদশ শতাব্দীতে তারা যখন এদেশে প্রবেশ করে ঠিক তখনই দেশি-বিদেশি শত্রুদের হাত থেকে নিজেদের বাঁচাতে এই গিরি নির্মান করে। অন্যদিকে আর একটি দল মনে করে জায়গা জমির সিমানা নির্ধারণের জন্য এটি তৈরি করা হয়েছে।
মাদারীপুরের যেকোনো মৌজায় জায়গা জমির পরিমাণ নিয়ে সমস্যা দেখা দিলে এই গিরিটিকে সিমানা হিসাবে ধরা হয়। গিরিটিকে তৈরি করা হয়েছে পাতলা ইট, চুন এবং সুরকি দিয়ে।
কিভাবে যাবেন
যারা মাদারীপুরের দর্শনীয় স্থান হিসেবে ঝাউদি গিরি উপভোগ করতে চান তাদের যেতে হবে মাদারীপুরের ঝাউদি ইউনিয়নে। বলে রাখা ভালো এই ঝাউদি ইউনিয়নটি মাদারীপুরের সদর উপজেলা। ঝাউদি গিরি যেতে হলে প্রথমে আপনাকে বাংলাদেশের যেকোনো স্থান থেকে বাসে বা ট্রেনে করে মাদারীপুর যেতে হবে।
ঢাকার গাবতলীতে সরাসরি মাদারীপুরে (madaripur) যাওয়ার বাস পাওয়া যায়। মূলত ঢাকা থেকে মাদারীপুর যেতে ৫ অথবা ৬ ঘন্টা সময় লাগে। আর বাস ভাড়া পড়ে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকার মতো। সোনালি পরিবহন, গোল্ডেন লাইন, সার্বিক পরিবহনসহ ঢাকা থেকে মাদারীপুর যাওয়ার বিভিন্ন মানসম্মত বাস রয়েছে।
ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে বাস বা ট্রেন করে মাদারীপুর সদর উপজেলায় যেতে হবে। সেখান থেকে রিকশা বা ইজি করে ঝাউদি গিরি যাওয়া যায়।
আওলিয়াপুর নীলকুঠি
মাদারীপুর দর্শনীয় এই স্থানগুলির লিস্টে নিঃসন্দেহে আওলিয়াপুর নীলকুঠিকে রাখা যায়। নাম দেখে নিশ্চয় বুঝতে পারছেন এটি ফরায়েজী আন্দোলনের সাথে সম্পর্কিকত একটি স্থাপনা। এছাড়াও গরিব চাষীদের উপর করা অন্যায় অনাচারের সাক্ষ্য বহন করে এই আওলিয়াপুর নীলকুঠি। এই নীলকুঠিটির ১২ টি কক্ষ রয়েছে। সেই সাথে রয়েছে একটি বিশাল আকারের চুল্লী।
এই চুল্লীটি কাজের সুবিধার্থে নীলকুঠির একেবারে মাঝ বরাবর তৈরি করা হয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে ৪০ ফুট উচ্চতার একটি চিমনি। পুরো স্থাপনাটি তৈরি করা হয়েছিল ১২ একর জমির উপর। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো বর্তমানে নীলকুঠির অধিকাংশ জায়গাই বেদখল হয়ে গেছে।
১৭০০ শতাব্দীর দিকে ব্রিটিশদের সাথে নীলকুঠিয়ালদের তুমুল যুদ্ধের কারণে এই স্থানটিকে স্থানীয়রা রণখোলা নামে ডেকে থাকে। এই আওলিয়াপুর নীলকুঠি ভ্রমনে আপনি যদি রাত্রি যাপন করতে চান সেক্ষেত্রে আপনাকে মাদারীপুরের বিভিন্ন আবাসিক হোটেলের সাহায্য নিতে হবে।
কিভাবে যাবেন
এই মাদারীপুরের দর্শনীয় স্থানের অবস্থান হলো ছিলারপুর ইউনিয়নের আওলিয়াপুর গ্রামে। যার দুরত্ব মাদারীপুর (madaripur) মেইন শহর থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটারের মতো। এক্ষেত্রে বাজেট করতে হবে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকার মধ্যে। মাদারীপুর জেলা সদর থেকে যেকোনো সিএনজি বা রিকশা করে আওলিয়াপুর নীলকুঠিতে পৌঁছে যাওয়া যাবে। গাড়ি চালক কে আওলিয়াপুর নীলকুঠির নাম বললেই তারা আপনাকে জায়গামতো নিয়ে যাবে।
শকুনি লেক
মাদারীপুরের দর্শনীয় স্থানের মাঝে এই শকুনি লেক হলো সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং উপভোগ করার মতো একটি পর্যটনকেন্দ্র। যা ১৯৪৩ সালে মাদারীপুর নির্মিত হয়। এটির নির্মাণের পেছনের কারণ হলো মাদারীপুর (madaripur) শহরকে প্রমত্তা আড়িয়াল খাঁ নদের পাড় থেকে নতুন করে স্থাপন করা। বিশেষ করি দক্ষিণে কিছুটা সরিয়ে এনে স্থাপন করাটাই ছিলো এই শকুনি লেক তৈরির অন্যতম কারণ।
আকারের দিক দিয়ে এই লেকটি ১,০১,১৭২ বর্গমিটার, দৈর্ঘ্য ৪৮৬ মিটার ও প্রস্থ ১৯৮ মিটার। শুরুর দিকে স্থানীয় শ্রমিকদের দ্বারা এটি তৈরি করানো হলেও শ্রমিকসংখ্যা কম থাকায় পরবর্তীতে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রসাশন ভারতের বিহার ও উড়িষ্যা অঞ্চল থেকে ২০০০ এর মতো শ্রমিক এনে এর কাজ সম্পন্ন করে। মূল লেকের সৌন্দর্য বাড়াতে এর সাথে নির্মাণ করা হয় বঙ্গবন্ধু ম্যুরাল, শহীদ কানন, শিশু পার্ক, স্বাধীনতা অঙ্গন, এমপি থিয়েটার মঞ্চ, শান্তি ঘাটলা এবং পানাহারের মতো দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা।
কিভাবে যাবেন
মাদারীপুরের দর্শনীয় স্থানের তালিকায় স্বগর্বে স্থান দখল করে নেওয়া এই শকুনি লেকের অবস্থান হলো মাদারীপুর পৌর এলাকায় শহরের কেন্দ্রে ১১১ নাম্বার শকুনি মৌজায়। যা প্রায় ১৯ একর স্থান জুড়ে তৈরি করা হয়েছিলো। শকুনে লেক যেতে ঢাকা এবং অন্যান্য সকল জেলা থেকে মাদারীপুর জেলায় পৌঁছাতে হবে। এক্ষেত্রে গাবতলী বাস স্ট্যান্ডের সাহায্য নিতে পারেন।
৩৫০ টাকা থেকে শুরু করে ৪০০ বা ৫০০ টাকা বাজেটে ঢাকা বা অন্যান্য জেলা থেকে মাদারীপুর (madaripur) পৌঁছানোর পর মাদারীপুর নতুন বাস স্ট্যান্ডে যাবেন। সেখানে একটি রিকশা ধরে শকুনি লেকে নিয়ে যেতে বললে তারা আপনাকে ঠিকই জায়গামতো পৌঁছে দেবে৷ এক্ষেত্রে ২০ টাকার মতো ভাড়া লাগবে।
মাদারীপুরের দর্শনীয় স্থান হিসাবে শকুনি লেক ভ্রমণে যদি থাকার প্রয়োজন পড়ে সেক্ষেত্রে হোটেল সার্বিক এবং হোটেল মাতৃভূমির সাহায্য নিতে পারেন। এই দু’টো হোটেলরই অবস্থান মাদারীপুরের জেলা শহরে। যেখানে থেকেই আপনি এই মানবসৃষ্ট লেকসহ মাদারীপুরের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান উপভোগের সুযোগ পাবেন।
আরও পড়ুনঃ লালন শাহ মাজার
পর্বত বাগান
এই পর্বত বাগানটি হলো প্রায় ৫০০ জাতের ফল ও ফুলের চারা সংগ্রহ করে প্রায় ২০ একর জমির ওপর গড়ে তোলা একটি বাগান। স্থানটিকে পর্বত বাগান হিসাবে নামকরণ করার কারণ হলো এটি গড়ে তুলেছিলেন রাস বিহারী পর্বত নামক এক ব্যাক্তি। বলা হয়ে থাকে এই বাগান তার যাত্রা শুরু করে ১৯৩০ সালের দিকে।
একজন প্রকৃতিপ্রেমিক মানুষ হওয়ায় এই ময়মনসিংহ জমিদারি সেরেস্তার নায়েবের চাকরি করা ব্যাক্তিটি বাগানটিকে ২০ একর জমির ওপর গড়ে তোলেন। উক্ত বাগানটির সবচেয়ে মনোরম দৃশ্য হলো এতে থাকা ফুল। গোলাপ, গন্ধরাজ, টগর, কামিনী, হাসনাহেনা, বকুল, জুঁই, বেলি, জবা থেকে শুরু করে প্রায় সকল জাতের ফুল গাছ রয়েছে এই বাগানে।
কিভাবে যাবেন
পর্বত বাগানে যেতে হলে ৫ ঘন্টা বা তার আশেপাশে সময় নিয়ে মাদারীপুরে পৌঁছাতে হবে। এরপর মাদারীপুর (madaripur) সদর উপজেলা থেকে কুমার নদীর দক্ষিণ দিকের তীরে যেতে হবে। আর এই তীরটির অবস্থান হলো মস্তফাপুর ইউনিয়ন। জায়গাটিকে স্থানীয়ভাবে মস্তাপুরও বলা হয়ে থাকে।
আর লোকাল যেকোনো সিএনজি বা রিকশা করেই এই দর্শনীয় স্থানটিতে যাওয়া যাবে। পর্বত বাগানে বেড়ানোর সময় রাত কাটানোর প্রয়োজন পড়লে আপনাকে মাদারীপুরের হোটেল সার্বিক বা হোটেল মাতৃভূমি অথবা হোটেল সৈকতের সাহায্য নিতে হবে।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়ি
জনপ্রিয় কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ২০০৩ সালে প্রথম মাদারীপুরে এসে যে বাড়িটি নির্মাণ করেন সেই বাড়িটি বর্তমানে পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। মূলত দেশান্তরিত হওয়ার অনেক বছর পর তিনি এই বাড়িটিতে থাকা শুরু করেন। ৭ একর জমির মধ্যে গড়ে উঠেছে এই কবির বাড়ি। যেখানে ঠাঁই পেয়েছে কবির বিভিন্ন স্মৃতি। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসাবে বাংলাভাষী সকলের কাছেই বেশ জনপ্রিয় ছিলেন এই কবি।
কিভাবে যাবেন
মূলত মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার মাইজপাড়া গ্রামে কবির এই বাসভবনের অবস্থান। এখানে যেতে হলে শুরুতে আপনাকে বাংলাদেশের যেকোনো জেলা থেকে মাদারীপুরে এবং মাদারীপুর জেলা সদর থেকে কালকিনি উপজেলায় যেতে হবে।
এখানে যেতে চাইলে স্থানীয় যেকোনো সিএনজির সাহায্য নিতে পারেন৷ সবশেষে কালকিনি উপজেলায় নেমে আরো একটি স্থানীয় সিএনজি ভাড়া করে সরাসরি পৌঁছে যেতে পারেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়িতে। আর যারা ভোজসবিলাসী তারা কালকিনি উপজেলাতেই ভালো মানের খাবার হোটেলে মানসম্মত যেকোনো খাবার ট্রাই করতে পারেন।
শেষ কথা
প্রায় ১,১৪৪.৯৬ বর্গকিমি বা ৪৪২.০৭ বর্গমাইলের এই জেলায় উপরোক্ত দর্শনীয় স্থান ছাড়াও আরো বেশকিছু উপভোগ্য স্থান রয়েছে। এই মাদারীপুরের দর্শনীয় স্থানগুলিতে একই ট্যুরে ঘোরাঘুরি করতে হলে হোটেল হোটেল সার্বিক বা হোটেল মাতৃভূমি অথবা হোটেল সৈকতের রুম বুক করে নিতে পারেন। পাশাপাশি এই যাত্রায় এখানকার জনপ্রিয় খাবার অর্থ্যাৎ খেজুরের গুড় এবং রসগোল্লা টেস্ট করতেও ভুলবেন না কিন্তু।
মাদারীপুরের দর্শনীয় স্থান সম্পর্কিত প্রশ্ন ও উত্তর / FAQ’s
১. মাদারীপুর কিসের জন্য বিখ্যাত ?
উত্তরঃ মাদারীপুর খেজুর গুড়ের জন্য বাংলাদেশে বিখ্যাত।
২. মাদারীপুর জেলা কোন বিভাগে ?
উত্তরঃ মাদারীপুর বাংলাদেশের ঢাকা বিভাগের মাদারীপুর জেলার সদরদপ্তর ও জেলা শহর।
৩. মাদারীপুর জেলার বিখ্যাত খাবার কি?
উত্তরঃ মাদারীপুর জেলার বিখ্যাত খাবার হলো খেজুরের গুড় এবং রসগোল্লা।
৪. মাদারীপুর জেলার থানার নাম কি?
উত্তরঃ মাদারীপুর জেলার থানার নাম হলো মাদারীপুর সদর, শিবচর, কালকিনি, রাজৈর এবং ডাসার
আরও পড়ুন-
পলওয়েল পার্ক, রাঙ্গামাটি
সাইরু হিল রিসোর্ট, বান্দরবান