জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ইতিহাস ও ক্যাম্পাস ভ্রমন

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

বাংলাদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নাম সামনে আসলেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়- এর নাম অবশ্যই শীর্ষে ভেসে আসে।

যদিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে এর যাত্রা ১৬৫ বছর আগেই শুরু হয়ে যায় কিন্তু বিভিন্ন কারণে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি পেতে এর অনেকটা সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। তবে জেনে নেয়া যাক জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা কিভাবে শুরু হল।

ঢাকা ব্রাহ্ম স্কুল থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

বুড়িগঙ্গা নদীর তীর ঘেঁষে ১৮৫৮ সালে ঢাকা ব্রাহ্ম স্কুল হিসেবে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু হয়। ইতিহাস থেকে জানা যায়,  প্রয়াত জগন্নাথ রায় চৌধুরী এই ঢাকা ব্রাহ্ম স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।পরবর্তীতে ১৮৭২ সালে এই স্কুলের মালিকানা পরিবর্তন হয়ে বালিয়াদির জমিদার কিশোরীলাল রায় চৌধুরীর হাতে চলে যায় এবং তখন এর নাম পরিবর্তন করে জগন্নাথ স্কুল রাখা হয়। খুবই অল্প সময়ে জগন্নাথ স্কুল পড়াশোনায় অনেক খ্যাতি অর্জন করে ফেলে।

এর ফলে ১৮৮৪ সালে স্কুল থেকে দ্বিতীয় শ্রেণির কলেজে উন্নীত হয়ে যায়। তখন জগন্নাথ স্কুলের নাম হয়ে যায় জগন্নাথ কলেজ। এরপর শিক্ষাবিভাগ ১৮৮৭ সালে স্কুল ও কলেজ আলাদা করে দেয় এবং ১৯০৮ সালে জগন্নাথ কলেজ প্রথম শ্রেণির কলেজে উন্নীত হয়। সেইসময় এটিই ছিল ঢাকার সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠান। 

জগন্নাথ কলেজের নতুন নামকরণ 

যেহেতু সেইসময় জগন্নাথ কলেজ তার শিক্ষাদান কর্মসূচি সফলতার সাথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল তাই এটিকে আরো উন্নয়নের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই পরিপ্রক্ষিতে এই কলেজে আই,এ, আই,এসসি, বি,এ (পাস) শ্রেণী ছাড়াও ইংরেজি, দর্শন ও সংস্কৃতি অনার্স এবং ইংরেজিতে মাস্টার্স চালু করা হয়।

কিন্তু ১৯২১ সালে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয় তখন জগন্নাথ কলেজের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়।শুধু তাই নয়, এই কলেজের ডিগ্রির ডিগ্রির শিক্ষক,শিক্ষার্থী, গ্রন্থাগারের বই পুস্তক এবং জার্নাল সবকিছু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।

এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারকে সাজানোর জন্য সেইসময়ে সেখানে জগন্নাথ কলেজের ৫০ ভাগ বই নিয়ে যাওয়া হয়।এরপরই জগন্নাথ কলেজ অবনমিত হয়ে যায় এবং এর নতুন নামকরণ করা হয় “জগন্নাথ ইন্টারমিডিয়েট কলেজ”।  

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়-এর জন্ম

যদিও জগন্নাথ কলেজের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষাক্রম বন্ধ হয়ে যায়, আবার ১৯৪২ সালে পুরান ঢাকার নারী শিক্ষা বাধা দূর করতে জগন্নাথ কলেজে সহশিক্ষা চালু করা হয়। কিন্তু আবার ১৯৪৮ সালে এই শিক্ষাক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়। কেননা, একবছর পর ১৯৪৯ সালে জগন্নাথ কলেজে আবার স্নাতক পাঠ্যক্রম আবার চালু করা হয়।

এরপর অধ্যক্ষ সাইদুর রহমান ১৯৬৩ সালে পুনরায় এই কলেজে সহশিক্ষা চালু করেন। ১৯৬৮ সালে জগ্ননাথ কলেজকে যদিও সরকারীকরণ করা হয়। আবার একবছর পর সেটিকে বেসরকারী মর্যাদায় নেয়া হয়। অবশেষে ২০০৫ সালে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একটি পরিপূর্ণ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপ নেয় এবং হয়ে ওঠে “জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়”।

এরপর থেকে ১৮বছর ধরে এই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় গর্বের সাথে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষাক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে মোট ছয়টি অনুষদের অধীনে ৩৬ টি বিভাগের ও ২টি ইন্সিটিউটের মাধ্যমে এখানে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। ঢাকা ব্রাক্ষ স্কুল থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে উঠার যাত্রা সহজ ছিল না।

বর্তমান সময়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার জন্য বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা আসেন। এমনকি প্রতিবছর এই বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আসনের জন্য ১৬-১৮ জন শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষায় লড়াই করেন। দীর্ঘ ১৬৫ বছরের সংগ্রাম এরপর এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত তখন ২০শে অক্টোবরকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। 

এই বিশ্ববিদ্যালয়টি বর্তমানে তাদের ২০০ একর জমি বুঝে পায় এবং এই জমির উপর তাদের নতুন ক্যাম্পাসের কাজ চালু হয়। কেরানীগঞ্জে হবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ক্যাম্পাস যা নজর কাড়বে সকলের এই বলে আশ্বাস দিয়েছেন প্রশাসন। তাছাড়া এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভবনসংখ্যা ১০ টি এবং ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ২৬ হাজার ও শিক্ষক আছেন প্রায় ৯৬০ জন।

ছাত্র-ছাত্রীদের থাকার জন্য হলেরও ব্যবস্থা রয়েছে এবং খাবারের জন্য রয়েছে ক্যান্টিনের ব্যবস্থা। এছাড়াও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে রয়েছে একটি শহীদ মিনার এবং একাত্তরের গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নামে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক ভাস্কর্য।  

ইতিহাসে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়-এর অবদান 

ইতিহাসে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়-এর অবদান অবিস্মরণীয় যা বলে শেষ করা যাবে না। বাংলদেশের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে শিক্ষা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬ দফা ও ১১ দফার আন্দোলন এবং উনসত্তরের গণঅভ্যুথান ও মুক্তিযুদ্ধসহ প্রতিটি আন্দোলনেই বেশ অবদান রেখেছে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। মনে পড়ে, “কী ও কেন” সাব-টাইটেলে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের যৌক্তিকতা বিশ্লেষণ করে একটি লেখা ফেব্রুয়ারি মাসে ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন’ নামে একটি পত্রিকায় প্রকাশ পায়। যা লিখেছিলেন জগন্নাথ কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান।

ভাষা আন্দোলনের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে একজোট হয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকগণ অংশগ্রহণ করেন। মাতৃভাষা বাংলার রাষ্ট্রীয় মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সর্বপ্রথম শহীদ হন জগন্নাথের হিসাব বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র রফিক উদ্দিন আহমদ।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে১৪৪ ধারা প্রথম যে ১০ জন ভেঙ্গে ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন জগন্নাথের ছাত্র, প্রখ্যাত কথাশিল্পী ও চলচ্চিত্র পরিচালক জহির রায়হান। ভাষা আন্দোলন নিয়ে ৬০-এর দশকেই চলচ্চিত্র নির্মাণ করে তিনি তার সাহসিকতার পরিচয় দেন।ভাষা সৈনিক মো. আবদুল জলিলও সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়ে ছিলেন ভাষা আন্দোলনে। 

এরপর ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনের বীজ জগন্নাথ ও ঢাকা কলেজ ক্যাম্পাসে বপণ করা হয়েছিল। ঐতিহাসিক শিক্ষা আন্দোলনের নেতা হায়দার আকবর খান বলেন, ‘যতদূর মনে পড়ে জগন্নাথ কলেজ ও ঢাকা কলেজের কয়েকজন ছাত্র প্রথমে ছাত্র সমস্যার দিকে দৃষ্টিপাত করে কলেজ থেকেই আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটায়।

পরবর্তী কালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতারা এই আন্দোলনটি আঁকড়ে ধরেন।’এমনকি বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত ছয় দফা আন্দোলনেও জগন্নাথের শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান আমলে সরকার বিরোধী আন্দোলন করে এই প্রতিষ্ঠান যার কারণে অনির্দিষ্টকালের জন্য জগন্নাথকে বন্ধ করে দেয় তৎকালীন সরকার।

১৮ বছরে জগন্নাথ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে জ্ঞানের সূর্য বলা যায়। হাজারো বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে আজও টিকে আছে এই প্রতিষ্ঠান। ১৮ বছর উপলক্ষে আনন্দ-উল্লাস করে এই প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষকসহ সকল শ্রেণীর কর্মচারী। নিজেদেরকে আন্তর্জাতিক মানের নীতিতে জানান দিতে সার্বক্ষণিক কাজ করে যাচ্ছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রার শুরু থেকেই সেমিস্টার পদ্ধতিতে পাঠদান চালিয়ে আসছে। ইউজিসির প্রতিবেদনে এ-গ্রেডভুক্ত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। সকল প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে এগিয়ে যাচ্ছে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা।

বলা বাহুল্য, স্পেনের সিমাগো ইনস্টিটিউশন র‍্যাংকিং-২০২২ এর আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে রসায়ন বিষয়ে গবেষণা সূচকে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রথম স্থান অর্জন করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

প্রতিটি ধাপে এবং মানবকল্যান কাজে এই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বেশ অবদান রেখে চলেছে। ২০২১ সালে যখন চারিদিকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যা বেড়ে যায় ঠিক তখন জগন্নাথের শিক্ষার্থীরা এগিয়ে আসে এবং মানুষিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে কাজ শুরু করে।

পরবর্তীতে ২০২২ সালের ৩ জানুয়ারি ভাষা শহীদ রফিক ভবনের নিচতলায় একটি কাউন্সেলিং সেন্টার স্থাপন করা হয় যার নাম দেওয়া হয় “জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কাউন্সেলিং সেন্টার”- যেখানে প্রতিনিয়ত শিক্ষার্থীদের মানসিক সমস্যা সমাধানে কাজ করে যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট সকলেই।

পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের সুবিধার্থে চালু করা হয় উন্মুক্ত লাইব্রেরি।এই ১৮ বছরে জগন্নাথের সফলতা অর্জনের ক্ষেত্রে কোন অংশে পিছিয়ে নেই এই বিশ্ববিদ্যালয়।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কিত প্রশ্ন ও উত্তর / FAQ:

১।জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কোথায় অবস্থিত?

উত্তরঃ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার সদরঘাটে অবস্থিত এবং নতুন ক্যাম্পাস কেরানীগঞ্জের তেঘরিয়ায়।

২। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে কি কি অনুষদ রয়েছে? 

উত্তরঃ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ছয়টি অনুষদ আছে তার মধ্যে বিভাগ আছে ৩৬ টি ও ইনস্টিটিউট রয়েছে ২টি। অনুষদগুলো হলঃ প্রাণ ও ধরিত্রী বিজ্ঞান অনুষদ, বিজ্ঞান অনুষদ, ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদ,সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ, কলা অনুষদ ও আইন অনুষদ।

৩।এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য  কে?

উত্তরঃ  জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপিকা ড.সাদেকা হালিম। 

৪।এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন উল্লেখযোগ্য ছাত্রের নাম কি? 

উত্তরঃ এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অসংখ্য উল্লেখযোগ্য ছাত্রবৃন্দ রয়েছেন তাদের মধ্যে কয়েকজনের নাম নিচে দেয়া হলঃ 

  • তাজউদ্দীন আহমেদ – (বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী)।
  • আনিসুজ্জামান-(শিক্ষাবিদ)।
  • রফিকউদ্দিন আহমেদ-(ভাষা শহিদ)। 
  • জয়নুল আবেদীন- (চিত্রশিল্পী)।
  • এটি এম শামসুজ্জামান-(অভিনেতা)। 
  • মানকুমার বসু ঠাকুর-(ব্রিটিশবিরোধী নৌবিদ্রোহের শহীদ) সহ আরো অনেকে।

আরও পড়ুন- 

যমুনা ফিউচার পার্ক

বিমান বাহিনী জাদুঘর

মন্তব্য করুন