হাম হাম ঝর্ণা ভ্রমণ, যাতায়াত খরচ ও ভ্রমণ গাইড

হাম হাম ঝর্ণা 

নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভরপুর বাংলাদেশ এমন কিছু জায়গা আছে যেখানে গেলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। তেমনি এক অপরূপ সৌন্দর্য্যে ঘেরা স্থান হাম হাম ঝর্ণা। আমরা আজকে আপনাদের বিস্তারিত জানাবো হাম হাম ঝর্ণা প্রসঙ্গে।

পৃথিবীর সৃষ্টি কত রোমাঞ্চকর তা দেখতে হলে জীবনে একবার হলেও হাম হাম ঝর্ণা ভ্রমণ করা উচিত। শুধু ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য নয় প্রকৃতিকে উপভোগ করার জন্য হলেও এখানে যাওয়া উচিত। ঝর্ণার নামকরণ সম্পর্কে বিভিন্ন অভিমত থাকলেও ঝরণার সাথে গোসলের সম্পর্ক করে

“হাম্মাম” (গোসলখানা) শব্দটি থেকে “হাম হাম” হয়েছে। তবে সিলেটের  স্থানীয়দের কাছে এটি “চিতা ঝর্ণা” হিসেবে পরিচিত, কেননা একসময় এজঙ্গলে নাকি চিতাবাঘ বাস করতো।

এই ঝর্ণা বর্ষাকালে তার যৌবন সবচেয়ে বেশি ফুটিয়ে তোলে। তবে এখানে যাওয়া একটু কষ্টকর। কারন ঝরণাটির কাছে যাওয়ার জন্য এখনও  সরকারিভাবে কোনো উদ্যোগ গৃহীত হয়নি।

আরও পড়ুনঃ সিলেটের দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ

অবস্থান 

হাম হাম ঝর্ণা

বাংলাদেশের মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার রাজকান্দির সংরক্ষিত বনাঞ্চলের গভীরে কুরমা বন বিট এলাকায় হাম হাম ঝর্ণা অবস্থিত। ২০১০ সালে  পর্যটন গাইড শ্যামল দেব বর্মার সাথে একদল পর্যটক দুর্গম জঙ্গলের ভিতর হাম হাম ঝর্ণা  আবিষ্কার করেন।

দুর্গম  এই ঝর্ণাটি ১৭০ ফুট উঁচু। যেখানে বাংলাদেশের সবচেয়ে উঁচু ঝর্ণা হিসেবে সরকারিভাবে স্বীকৃত মাধবকুণ্ড জলপ্রপাতের উচ্চতা ১৬২ ফুট।  তবে ঝরণার উচ্চতা বিষয়ে কোনো প্রতিষ্ঠিত কিংবা পরীক্ষিত মতামত না থাকায় এটি এখনো সবচেয়ে উঁচু  ঝর্নার স্বীকৃতি পায়নি।

ঝর্ণার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য বর্ননা 

দীর্ঘ  উঁচু নিচু পাহাড়ি  রাস্তা  পার হয়ে পাহাড়ের ধার বেয়েই যেতে হয় হাম হাম ঝর্ণা দেখতে। হাম হাম ঝর্ণা যাবার পথে রয়েছে সারি সারি জারুল, চিকরাশি কদম ও ডুমুর গাছ। এর ফাঁকে ফাঁকে উড়তে থাকে রং-বেরঙের প্রজাপতি। পাশের বেত বাগানে দেখা মিলবে অসংখ্য হনুমানের। 

কিভাবে যাবেন

ঢাকা থেকে হাম হাম ঝর্ণা যেতে শ্রীমঙ্গল হয়ে যাওয়া সবচেয়ে সুবিধাজনক। সেক্ষেত্রে কমলাপুর বা বিমান বন্দর রেলওয়ে স্টেশান হতে উপবন, পারাবত, জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস ট্রেনে করে প্রথমে শ্রীমঙ্গল আসতে হবে। যানবাহনের ধরন বুঝে ভাড়া পড়বে ২৮০ থেকে ৬০০টাকা।

ট্রেনে শ্রীমঙ্গল যেতে সময় লাগে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা।বাসে করে ঢাকা থেকে শ্রীমঙ্গল যেতে ফকিরাপুল অথবা সায়দাবাদ বাস স্ট্যান্ড  থেকে  হানিফ এন্টারপ্রাইজ, শ্যামলী পরিবহন, সিলেট এক্সপ্রেস, এনা ইত্যাদি এসি ও নন এসি বাস পাওয়া যায়। এসব বাসে ভাড়া জনপ্রতি  ৫২০ থেকে ৬০০ টাকা। ঢাকা থেকে বাসে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে  শ্রীমঙ্গলে পৌছানো যায়।

শ্রীমঙ্গল থেকে যাবার উপায় 

শ্রীমঙ্গল থেকে হাম হাম ঝর্ণা যাবার  জন্য খুব সকালে রওনা দিলে ভাল হয়। কারন তাহলে রাতারাতি ফিরে আসা  যায়। সেক্ষেত্রো প্রথমে আপনাকে যেতে হবে কলাবন পাড়ায়। শ্রীমঙ্গল থেকে কলাবন পাড়া আপ ডাউন সিএনজি ভাড়া ১১০০ থেকে ১২০০ টাকা, এক গাড়িতে ৪ – ৫  জন যাওয়া যায়।

এছাড়া যাওয়ার জন্যে রয়েছে জীপ গাড়ি। কলাবন পাড়া পৌছে  ২৫০ থেকে ৩০০ টাকার মধ্যে একজন ভাল  ট্যুরিস্ট গাইড ঠিক করে নিতে হবে। ভ্রমণের সময় প্রত্যেকের সাথে বাঁশের লাঠি নিতে ভুল করা যাবেনা। কারন কলাবন পাড়া থেকে হামহাম যাবার দুটো ট্রেইল রয়েছে, ঝিরি পথ ও পাহাড়ি পথ।

ঝিরি পথে সময় একটু বেশি লাগলেও এই পথের সৌন্দর্য্য পাহাড়ি পথের চেয়ে বেশ মনোমুগ্ধকর। আর এই ঝিরি পথের ঝুঁকি এড়াতেই সাথে বাঁশের লাঠি নিতে হবে। কলাবন পাড়া থেকে হাম হাম ঝর্ণা যেতে  সময় লাগবে ২ থেকে ৩ ঘন্টা। 

কখন যাবেন 

হাম হাম ঝর্ণা দেখতে যাওয়ার উপযুক্ত সময় হলো বর্ষাকাল।কারন বর্ষাকালে এর প্রকৃত রূপ ফুটে ওঠে।পাহাড়ের কোল ঘেসে পানির অফুরন্ত ঝর্ণা নেমে আসে।চারদিকে সবুজ গাছপালা যেন মনকে ছুয়ে যায়। তবে একটু ঝুঁকি থাকে কারন বর্ষায় পথ পিচ্ছিল থাকে তাই দূর্ঘটনা ঘটতে পারে।

গ্রীষ্মকালে পানির প্রবাহ কম থাকে।পাছপালা হলুদ হয়ে যায় তাও অনেকে যায়।তবে শীতকালে পর্যটক হাম হাম ঝর্ণা দেখতে যায়না বললেই চলে কারন বেলা কম থাকে।পানি একেবারেই কম থাকে সেই সাথে প্রচন্ড শীত। 

কোথায় থাকবেন

হাম হাম ঝর্নার আশেপাশে থাকার মতো কোন ব্যবস্থা নেই। থাকতে হলে পুনরায় ফিরে আসতে হবে  শ্রীমঙ্গলে। তাই খুব সকালে রওনা দিয়ে দিনে দিনে হাম হাম ঝর্ণা থেকে ফিরে আসাই উত্তম। কেউ একান্তই ফিরতে না পারলে  আদিবাসীদের সাথে কথা বলে তৈলংবাড়ী কিংবা কলাবন পাড়াতে থাকতে পারেন।

শ্রীমঙ্গলে থাকার জন্য বিভিন্ন মানের বেশ কিছু হোটেল আছে।এদের মধ্যে হোটেল গ্র্যান্ড সুলতান,নিসর্গ ইকো কটেজ, টি মিউজিয়াম রিসোর্ট, লেমন গার্ডেন রিসোর্ট, হোটেল প্লাজা, নভেম রিসোর্ট, বি.টি.আর.আই ইত্যাদি সেরা।

কি কি খাবেন 

হাম হাম ঝর্ণার আশেপাশে খাবারের কোন ব্যবস্থা নেই। তবে  খিদে মেটানোর জন্য কলাবন পাড়ায় থাকাকালীন সময়ে কিছু খাবার খেয়ে নিতে পারেন।তবে ভারী খাবার পাওয়া না গেলেও  হাম হাম ঝর্ণা এর পাদদেশে চা, ছোলাবুট, চিড়াভাজা পাওয়া যায়।

অনেকে ভ্রমনের সময় সাথে শুকনো খাবার নিয়ে যায়।এদিকে আবার কলাবন পাড়ায় স্থানীয় মানুষদের দেওয়া একটা ছোট হোটেল রয়েছে।কিন্তুু সমস্যা হলো সেখানে খাবার রেডি করা থাকেনা।আাপনি যাবার কোন খাবার খেতে চাইলে তা অর্ডার করে গেলে ফিরে আসার পর খেয়ে  পারবেন। 

আশেপাশের দর্শনীয় স্থান

হাম হাম ঝর্ণা ভ্রমণ করতে গেলে আপনি চাইলে এর আশেপাশের কিছু দর্শনীয় স্থানও ঘুরে আসতে পারেন যেমন:

লাউয়াছড়া উদ্যান

মাধবপুর লেক

চা বাগান

সাত রঙের চা – নীলকন্ঠ কেবিন

বাংলাদেশ চা গবেষণা ইন্সটিটিউট

ভ্রমণ টিপস ও সতর্কতা

টিপস:

১.বর্ষাকালে হাম হাম ঝর্ণা ভ্রমণ করতে গেলে ট্রেকিং করার জন্যে হাইকিং অথবা  ভালো গ্রীপের জুতো ব্যববার করবেন।

২.ব্যাকপ্যাক যত সম্ভব হালকা রাখবেন।

৩.ফার্স্ট এইডের জন্যে যা প্রয়োজন সাথে রাখতে হবে। 

৪.সাথে পর্যাপ্ত পানি নিতে হবে। 

৫.গরমের দিনে গেলে নিজেকে ডিহাইড্রেটেড রাখতে খাবার স্যালাইন নিতে পারেন।

 সতর্কতা :

১.হাম হাম ঝর্ণা ভ্রমণকালে পাহাড়ি উঁচু নিচু রাস্তায় চলার সময় সাবধান থাকবেন।

২.ঝর্ণা ও ট্রেইলে দয়া করে কোন ধরনের ময়লা আবর্জনা ফেলবেন না।এতে সৌন্দর্য্য নষ্ট হয়।

৩.স্থানীয় মানুষদের সাথে কোন প্রকার ঝামেলায় জড়াবেননা।

৪.সন্ধ্যার আগেই ফেরার চেষ্টা করতে হবে।

শেষকথা

২০১০ সালের শেষের দিকে একদল পর্যটক হাম হাম ঝর্ণা  আবিষ্কারের দাবি করলেও স্থানীয়দের দাবি তার এই ঝর্না সম্পর্কে আগে থেকেই জানতেন। বর্তমান সরকারের সঠিক পৃষ্ঠোপোষকতা পেলে এটি হয়ে উঠবপ দেশের অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র।

তাছাড়া যোগাযোগ পথটাও সুগম করা দরকার। সেই সাথে দরকার ভালো থাকা খাওয়ার ব্যাবস্থা। তাছাড়া যে কোন পর্যটনকেন্দ্র  আমাদের দেশের সম্পদ।

এইসব স্থানের প্রকৃতি কিংবা সৌন্দর্য্যের জন্যে ক্ষতিকর এমন কিছু করা  থেকে বিরত থাকতে হবে।সেইসাথে অন্যদেরকেও উৎসাহিত করতে হবে। কারন দেশটা আমাদের তাই এর সুরক্ষা ভারও আমাদের উপর।

হাম হাম ঝর্ণা সম্পর্কিত প্রশ্ন ও উত্তর /FAQ

১.হাম ঝর্ণা কেথায় অবস্থিত?

উত্তর : হাম হাম  ঝর্ণা  বাংলাদেশের মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার রাজকান্দি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের গভীরে কুরমা বন বিট এলাকায় অবস্থিত।

২.হাম হাম ঝর্ণায় কিভাবে যাবেন?

উত্তর: ঢাকা থেকে ঝর্ণা দেখতে যেতে হলে শ্রীমঙ্গল হয়ে যাওয়া সবচেয়ে সুবিধাজনক। কমলাপুর বা বিমান বন্দর রেলওয়ে স্টেশান হতে পারাবত, জয়ন্তিকা বা উপবন এক্সপ্রেস ট্রেনে করে শ্রীমঙ্গল আসতে হয় পরে সেখান থেকে ৫-৬ ঘন্টা সময় লাগে ঝর্ণার কাছে পৌছাতে।

আরও পড়ুন-

মেরিন ড্রাইভ রোড, ভ্রমন গাইড ও দর্শনীয় স্থানসমুহ

ফয়েজ লেক – চট্টগ্রাম

মন্তব্য করুন