ভাসমান পেয়ারা বাজার
বাংলাদেশে বরিশাল (Barisal) বিভাগে চালু থাকা ভাসমান পেয়ারা বাজার এর কথা শুনেছেন কি? না শুনে থাকতেই পারেন, কারণ অনেকেই জানেন না এ বাজারের কথা। এ বাজার মূলত পেয়ারার জন্য বিখ্যাত এবং পেয়ারার মৌসুমে এ বাজারে সর্বোচ্চ বিক্রি হয়।
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের বরিশালের মনোরম অঞ্চলে লুকিয়ে আছে এই লুকানো রত্ন যা স্থানীয় বাণিজ্যের প্রাণবন্ত চেতনার সাথে প্রকৃতির সৌন্দর্যকে মিলিত করে। কিন্তু একে ভাসমান পেয়ারা বাজার (Floating guava market) বলার কারণ কি?
মূল কারণ হলো ঝালকাঠি, বরিশাল ও পিরোজপুর- এ তিন জেলার সীমান্তে এশীয় মহাদেশের সবচেয়ে বড় পেয়ারা বাগান (Guava garden) গড়ে উঠেছে। তাই সারা বছর এই বাজারটি চালু থাকলেও পেয়ারার মৌসুমে এটি সক্রিয় হয়ে ওঠে। ঝালকাঠি শহর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে ছোট জিগজ্যাগ খালে (zigzag canal) সপ্তাহের প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ব্যবসা চলে।
আমাদের আজকের এই আর্টিকেল ভাসমান পেয়ারা বাজার (vasoman peyara bazar) নিয়ে,যেখানে আমরা আপনাকে এই মনোমুগ্ধকর বাজারের সম্পর্কে জানাবো, এবং একই সাথে আপনাকে এখানে ভ্রমণের পরিকল্পনা (travel plans) করার জন্য প্রয়োজনীয় গাইড সম্পর্কে বিস্তারিত জানাব।
আরও পড়ুনঃ শরীয়তপুরের দর্শনীয় স্থান
ভাসমান পেয়ারা বাজার কিভাবে যাবেন
ভাসমান পেয়ারা বাজারটি (Floating guava market) বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলা পিরোজপুরের নেছারাবাদ উপজেলার অন্তর্গত স্বরূপকাঠির কীর্তিপাশা খালের উপর ভিমরুলীতে (vimruli) অবস্থিত। এ অঞ্চলে জুলাই মাস থেকে পেয়ারা হার্ভেস্টিং (Guava harvesting) শুরু হয় এবং সেপ্টেম্বর (September) পর্যন্ত চলে।
তাই, পরিদর্শন করার আদর্শ সময় হবে জুলাইয়ের শেষে। এছারাও কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত ভ্রমণ সম্পর্কে বিস্তারিত পড়ুন এখানে।
লঞ্চে ভাসমান পেয়ারা বাজার যাবার উপায়
আপনি যদি অন্তত কয়েক দিনের সফরের পরিকল্পনা (Plan for trip) করে থাকেন, তাহলে রাতের মধ্যে লঞ্চ ভ্রমণ করা ভালো কারণ আপনি সদরঘাটেই রাতের বরিশালের উদ্দেশ্যে লঞ্চ (launch) পাবেন। বরিশাল সদরঘাটে লঞ্চ (Launch) থেকে নেমে সিএনজি বা অটো নিয়ে বানারীপাড়া লঞ্চ (banaripara) ঘাটে চলে যান।
সেখান থেকে ট্রলার বা নৌকা ভাড়া করে ভিমরুলী (Bhimruli) যেতে পারেন। লঞ্চ ভ্রমণের জন্য সুরভি ৯ এর মতো লঞ্চগুলি সদরঘাট (Sadarghat) থেকে রাত ৮ টায় ছেড়ে যায় এবং ভোর ৩ টার মধ্যে বরিশালে পৌঁছায়। সদরঘাট থেকে সন্ধ্যা ৬ টায় এমভি টিপু-২ ও সুন্দরবন-২ ঝালকাঠির উদ্দেশে রওনা হয়।
স্টিমারে ভাসমান পেয়ারা বাজার যাবার উপায়
ঢাকা সদরঘাট থেকে সন্ধ্যা ৬টায় পিআইডব্লিউটিএ রকেট-স্টিমার (Rocket-Steamer) পিএস মহাসুদ, পিএস অস্ট্রিচ, এবং পিএস টার্নসহ ঝালকাঠির (Jhalakathi) উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। প্রথম শ্রেণীর কেবিনের (Cabin) জন্য প্রয়োজন হবে ১২৫০ টাকা, দ্বিতীয় শ্রেণীর কেবিনের জন্য জনপ্রতি ৭৬০টাকা। আর তৃতীয় শ্রেণীর কেবিনের জন্য খরচ পড়বে ১৯০ টাকা।
বাসে যাবার উপায়
যেহুতু এখন পদ্মা সেতুর (Padma Bridge) কাজ শেষ, তাই এখন আপনি ৬-৮ ঘণ্টার মধ্যে বাসে করে পিরোজপুর (Pirojpur) যেতে পারবেন। এক সময় ৬ থেকে ৮ ঘণ্টায় বাসে করে পিরোজপুর যাওয়া ছিল অকল্পনীয়,কারণ তখন ফেরি (Ferry) পারাপার ছাড়া অন্য কোন উপায় ছিল না।
ঢাকা গাবতলী (gabtoli) থেকে ঝালকাঠি (Jhalakathi) যাওয়ার বেশ কিছু বাস পাবেন। এসি বাসের সিটের জন্য ৮০০ টাকা লাগবে এবং নন-এসির জন্য ৩৫০-৪৫০ টাকা লাগবে। বাসের মধ্যে রয়েছে দ্রুতি, ঈগল, সুরভী, সাকুরা ইত্যাদি। আপনি সায়েদাবাদ (sayedabad) থেকেও বাস পাবেন, যেমন সুগন্ধা।
প্লেনে যাবার উপায়
আপনি যদি বিমানে যেতে পছন্দ করেন তবে ঢাকা থেকে বরিশাল সরাসরি ফ্লাইট রয়েছে। নভোএয়ার (Novo-Air), ইউএস-বাংলা (US-Bangla) ও বিমান বাংলাদেশ (Biman Bangladesh) এই রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করে।
ভিমরুলী বাজারে কিভাবে পৌঁছাবেন
ঝালকাঠি থেকে ভাসমান পেয়ারা বাজারে (vasoman peyara bazar) যাওয়ার জন্য মোটরবাইক পাবেন যাতে আধা ঘণ্টা সময় লাগবে। আপনি ঝালকাঠি লঞ্চঘাট থেকে ইঞ্জিন বোট পাবেন যা পেয়ারা বাজার দেখার জন্য পর্যটকদের মধ্যে পছন্দনীয় এবং আরামদায়ক চয়েস বলে পরিচিত। এভাবে ভিমরুলী বাজারে পৌঁছাতে সময় লাগবে ১ ঘণ্টা। ১০ থেকে ১৫ জনের ইঞ্জিন বোটে সারা দিনের জন্য আপনার খরচ পড়বে ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকা।
সেক্ষেত্রে গ্রূপে থাকা ভালো। খুলনা হাইওয়ে (Highway) সড়কে আপনি ঝালকাঠি যাওয়ার বাস পাবেন। ড্রাইভারকে বলুন ঝালকাঠির পরে আপনাকে কীর্তিপাশা মোড়ে নামিয়ে দিতে। ৬০ টাকা খরচ হবে এখানে। এখান থেকে আপনি ভিমরুলি ভাসমান পেয়ারা বাজারের জন্য সরাসরি অটো পাবেন।
খাবার ব্যবস্থা
ভিমরুলি বাজার থেকে সাদা ও লাল মিষ্টি, কুড়িয়ানা বাজারে ঋতুপর্ণা দোকানের গরম মিষ্টি ও বৌদির হোটেলে দুপুরের খাবার এবং গুঠিয়ার সন্দেশ। এগুলো ভিমরুলি (vimruli) বাজারের অতি পরিচিত খাবার।
এছাড়া বরিশাল শহরের পুরান বাজার এলাকার হক এর রসমালাই, রসগোল্লা বা ছানা, বটতলার শশীর রসমালাই, নয়াবাজার মোড়ের নিতাই মিষ্টান্ন ভান্ডারের স্পঞ্জ মিষ্টি, বিবির পুকুর পাড়ের কাছে চটপটি, দধি ঘোরের দই, ঘোল এবং ঘোল-মুড়ি মিক্সড খেতে পারেন। খাবারের দাম খুব বেশি নয়। মানের দিক দিয়ে পর্যটকদের কাছেও অনেক পরিচিত।
কোথায় থাকবেন
বাজারের কাছাকাছি পিরোজপুরে রেস্টুরেন্ট (Restaurant) এ থাকার ব্যবস্থা আছে, অথবা আপনি বরিশালের কোনো হোটেলে (Hotel) থাকতে পারেন এবং সেখান থেকে পিরোজপুর যেতে পারেন। যদি আপনার কাছে এত বেশি সময় না থাকে তবে আপনি রাতে বাসে করে বাড়ি ফিরে যেতে পারেন যার জন্য হোটেল বুক করার প্রয়োজন হবে না।
শহরের কিছু সুপরিচিত হোটেলের মধ্যে কালীবাড়ি রোডে ধানসিঁড়ি রেস্ট হাউস, বাতাস পট্টিতে আরাফাত বোর্ডিং, সদর রোডে হালিমা বোর্ডিং রয়েছে। এখানে ভাড়া ১০০ থেকে ৩০০ টাকার মধ্যে পাবেন। স্বরূপকাঠিতে (swarupkathi) মিয়ার হাটে হোটেল ইফতি রয়েছে। লাইফ ভেস্ট, রেইনকোট, পলিথিন, প্রয়োজনীয় ওষুধের পাশাপাশি কিছু শুকনো খাবার নিতে ভুলবেন না।
আরও পড়ুনঃ জাতীয় স্মৃতিসৌধ (সাভার, ঢাকা)
কেন ভাসমান পেয়ারা বাজার পর্যটকদের মুগ্ধ করে
ভীমরুলীতে (vimruli) পৌঁছলে ভাসমান বাজারের দৃশ্য ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাবেন না আপনি, শুধু বয়ে যাওয়া নদী, পেয়ারা ভর্তি নৌকা; খালের দুই ধারের ঐশ্বর্যময় সবুজের ছোঁয়া – এসব দেখে আপনার মনে হবে যেন আপনি এক টুকরো স্বর্গে প্রবেশ করেছেন, এমনকি বছরের সবচেয়ে আর্দ্র সময়েও।
খাল থেকে দৃশ্যটি নয়নাভিরাম, অনেক পর্যটক মন্তব্য করেছেন যে তাদের মনে হয়েছে যেন তারা আমাজন (Amazon) বনে আছেন। একজন পর্যটক (Tourist) হিসেবে আপনার জন্য সবচেয়ে ভাল হবে যদি আপনি আপনার সময় নিয়ে একটি ছোট নৌকায় বাজার ঘুরে দেখেন।
মজার ব্যাপার হলো এখানে আসা সব নৌকার সাইজ এবং ডিজাইন প্রায় একই রকম। মনে হবে যেন সব নৌকাই একই কারিগরের তৈরি। খালের মোহনায় বসে এই ভিমরুলির ভাসমান পেয়ারা বাজার যেখানে তিন দিক থেকে তিনটি খাল এসে মিশেছে।
বাজারের উত্তর প্রান্তে খালটি অতিক্রম করার জন্য একটি ছোট সেতু রয়েছে৷ এটিকে একটি ওয়াচ টাওয়ার (Watch Tower) হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে কারণ সেই জায়গা থেকে পুরো বাজারটি খুব ভালভাবে দেখা যায়। বাজারের চারপাশের মনোরম সৌন্দর্য এবং পরিবেশ আপনাকে বাংলার প্রাণকেন্দ্রে থাকা অবস্থাতেই থাইল্যান্ড (Thailand) বা ভেনিসে (Venice) পৌঁছে দিতে পারে।
ভাসমান পেয়ারা বাজারের অর্থনৈতিক গুরুত্ব
ভিমরুলীর আশপাশের সব গ্রামেই অনেক পেয়ারা বাগান (Guava Garden) রয়েছে। এসব পেয়ারা বাগান (peyara bagan) থেকে কৃষকরা নৌকায় করে সরাসরি বাজারে পেয়ারা (peyara) নিয়ে যায়। পিরোজপুর, বরিশাল ও ঝালকাঠি জেলার কৃষকরা জুলাই মাস থেকে পেয়ারা ভর্তি শতাধিক ছোট নৌকা এখানে জড়ো হয়।
পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলার ভিমরুলি, আটঘর ও কুড়িয়ানায় ৩১,০০০ একর জমিতে ২৬টি সম্প্রদায়ের ২০,০০০ পরিবার পেয়ারা (guava) চাষ করে।
স্থানীয় পেয়ারা বাজারের চাহিদার প্রায় ৬০ শতাংশ এখান থেকে সরবরাহ করা হয়। পেয়ারা ডিলাররা নৌকায় পেয়ারা নিয়ে আসে এবং প্রতি ৪০ কেজিতে ২৫০-৩০০ টাকায় পাইকারি বিক্রি করে। ভাসমান পেয়ারা বাজারের কারণেই ভিমরুলি গ্রামটি সাম্প্রতিক বছরগুলিতে পর্যটকদের কাছে একটি আকর্ষণীয় স্থান হয়ে উঠেছে যা অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে। ভিমরুলি বাজারের ব্যস্ততম সময় হল দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত। এ সময় নৌকার সংখ্যা কয়েকশ ছাড়িয়ে যায়।
শেষ কথা
আপনি যখন ভিমরুলিতে পৌঁছাবেন তখন ভাসমান বাজারের মহিমাকে ছাড়িয়ে দেখবেন পারস্পরিক সংযোগকারী নদী, পেয়ারা বোঝাই নৌকা, এবং খালের উভয় প্রান্তে বিলাসবহুল ঝরা পাতা -যা দেখে আপনার অনুভব হবে যেন আপনি স্বর্গের একটি অংশে প্রবেশ করেছেন।
এই মোহনীয় বাজারের মুগ্ধতায় নিজেকে সম্পূর্ণরূপে নিমজ্জিত করতে পেয়ারার মৌসুমে ভ্রমণের পরিকল্পনা করুন, ভিমরুলি ভাসমান পেয়ারা বাজার (vimruli peyara bajar) যান এবং গ্রামের নির্মল মনোমুগ্ধকর পরিবেশে ঘেরা তাজা পেয়ারাগুলির স্বাদ নিয়ে আসুন।
ভাসমান পেয়ারা বাজার নিয়ে কিছু প্রশ্ন ও তার উত্তর / FAQ
১. ভাসমান পেয়ারা বাজার কোথায় অবস্থিত?
উত্তর – ভাসমান পেয়ারা বাজারটি বরিশাল (barisal) বিভাগে অবস্থিত।
২. ভাসমান পেয়ারা বাজার ভ্রমণের সঠিক সময় কোনটি ?
উত্তর – ভাসমান পেয়ারা বাজার পরিদর্শন করার আদর্শ সময় হবে জুলাইয়ের (july) শেষে যখন পেয়ারা হার্ভেস্টিং শুরু হয়।
৩. বরিশাল অঞ্চলে পেয়ারা বিখ্যাত কেন?
উত্তর – মিষ্টি স্বাদ ও পুষ্টিগুণ এর কারণে বরিশাল অঞ্চলে পেয়ারা বিখ্যাত।
আরও পড়ুন-
মাওয়া রিসোর্ট (লৌহজং, কান্দিপাড়া ) মুন্সিগঞ্জ
পদ্মা রিসোর্ট (লৌহজং, মুন্সীগঞ্জ)