কার্জন হল (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)

কার্জন হল

কার্জন হল (Curzon Hall). যা কিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অবস্থিত প্রায় ১১৫ বছরের পুরনো একটি ঐতিহাসিক ভবন এবং পুরাকীর্তি। এই ঐতিহাসিক কার্জন হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে বেশ জনপ্রিয় একটি জায়গা। এর সৌন্দর্য উপভোগ করতে শিক্ষার্থীরা ছাড়াও অনেকেই এখানে ঘুরতে আসেন।

বর্তমানে এই কার্জন হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ও জীব বিজ্ঞান অণুষদের পাঠদানে ব্যবহার করা হচ্ছে। আগে বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার পর থেকে ১৯২১ সালের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত কার্জন হল ঢাকা কলেজ ভবন হিসেবেই ব্যবহার করা হত। 

কার্জন হল একটি শান্তি পূর্ণ জায়গা, চারদিকের সাজানো পরিবেশ,শান্ত মূহুর্ত যে কারো মন কেড়ে নিবেই। যারা এখনো কার্জন হল যান নি, আজকের আর্টিকেলটি আমি তাদের জন্যই সাজিয়েছি।

কারণ এই এই আর্টিকেলে আমি বলব কিভাবে ঐতিহাসিক কার্জন হল যাবেন, গিয়ে কি কি দেখবেন, কার্জন হল এর ইতিহাস ও ইত্যাদি বেশ কিছু খুুঁটিনাটি বিষয়। তাহলে চলুন দেরি না করে শুরু করি।

আরও পড়ুনঃ কুমিরা ঘাট, চট্রগ্রাম

কার্জন হল নির্মাণের ইতিহাস 

এই কার্জন হল(Curzon Hall) মূলত ঠিক কি কারণে নির্মিত হয়েছিল ইতিহাসবিদদের মধ্যে এ নিয়ে রয়েছে বেশ দ্বিমত। জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়ার মতানুসারে, হলটি নির্মিত হয়েছিল নাকি মূলত একটি টাউন হল হিসেবে। আর উনিশ শতকের শেষদিক হতে শুরু হওয়া ঢাকার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদির জন্যই নাকি এই টাউন হলটি নির্মিত হয়েছিল।

আর ইতিহাসবিদ আহমেদ দানী বাংলাপিডিয়ার এ মতের প্রতি সমর্থন দিয়েছেন। তবে এদিকে আবার আরেক ইতিহাসবিদ শরীফউদ্দিনের মতে, এ তথ্যটি নাকি ভুল। এটি সঠিক নয়। তার মতে, কার্জন হল নির্মাণ করা হয়েছিল ঢাকা কলেজের সম্প্রসারিত একটি ভবন হিসেবে এবং এর জন্য অনুদান প্রদান করেন ভাওয়ালের এক রাজকুমার।

কার্জন হল নির্মাণের ইতিহাস

১৯০৪ সালের ঢাকা প্রকাশ থেকে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে দেখা যায়, যেখানে ঐতিহাসিক কার্জন হল নিয়ে বলা হয়েছে। ঢাকা কলেজ নিমতলীতে স্থানান্তরিত হইবে। এই কলেজের সংশ্রবে একটি পাঠাগার নির্মাণের জন্য সুযোগ্য প্রিন্সিপাল রায় মহাশয় যত্নবান ছিলেন।

বড়লাট বাহাদুরের আগমনে ভাওয়ালের রাজকুমারগণ এ অঞ্চলে লর্ড বাহাদুরের নাম চিরস্মরণীয় করিবার নিমিত্তে কার্জন হল নামের একটি সাধারণ পাঠাগার নির্মাণের জন্য দেড় লক্ষ টাকা দান করিয়াছেন।

এবং বাংলাপিডিয়া থেকে আরও জানা যায় যে, ১৯১১ সালের দিকে বঙ্গভঙ্গ রদ হয়ে গেলেই নাকি এই ভবন ঢাকা কলেজের একাডেমিক ভবন হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হয়। তারও পরে ১৯২১ সালের দিকে  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে বিজ্ঞান অনুষদের বিভিন্ন বিভাগের শ্রেণীকক্ষ ও পরীক্ষাকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার হতে শুরু করে যা এখনো পর্যন্ত এভাবেই চলে যাচ্ছে।

ভাষা আন্দোলনে এই হলের ভূমিকা

ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে কার্জন হলের (Curzon Hall) সাথে ভাষা আন্দোলন কিভাবে  জড়িয়ে আছে। ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় এখানেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু জিন্নাহর এমন ঘোষণার প্রতি প্রথম প্রতিবাদ জানিয়েছিল। ১৯৪৮ সালের ২৪ মার্চ ঐতিহাসিক কার্জন হল অনুষ্ঠিত হয়েছিল বিশেষ সমাবর্তন।

যেখানে জিন্নাহ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু হবে বলে ঘোষণা করলে হলে উপস্থিত ছাত্ররা তখনই ‘নো-নো’ বলে প্রতিবাদ জানায়। এ থেকে বোঝা যায় ভাষা আন্দোলনের সাথে কার জন হলের সম্পর্ক রয়েছে। ভাষা আন্দোলনের প্রথম প্রতিবাদ বলা যায় এখান থেকেই শুরু হয়। 

কার্জন হলের বিবরণ

ইউরোপ ও মোগল স্থাপত্য রীতির অপূর্ব সংমিশ্রণে নির্মিত হয়েছে দ্বিতল এই ঐতিহাসিক কার্জন হল। যাকে ঢাকার অন্যতম স্থাপত্য নিদর্শন হিসেবেও বিবেচনা করা হয়ে থাকে। সম্পুর্ন কার্যন হলের রঙ হলো লাল। আর লাল রঙা কারুকার্যময় এই সুন্দর ভবনের অভ্যন্তরে রয়েছে বিশাল বড় একটি কেন্দ্রীয় হল।

হলের একেবারে সামনেই রয়েছে একটি সুন্দর বাগান। যেখানে নানান বাহারি গাছ আছে, আছে ফুল গাছও। এত মধুর লাগে তা দেখতে। বাগানের ভেতর দিয়ে একটি চমৎকার রাস্তা পশ্চিম থেকে পূর্বে দিকে  চলে গেছে। 

কার্জন হলের(Curzon Hall) ঠিক পেছনের দিকেই রয়েছে প্রায় ৪০০ বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী মুসা খাঁ মসজিদ। যা আজ থেকে চারশত বছর আগে নির্মাণ করা হয়েছিল। তাছাড়া আছে একটি বিশাল পুকুর। এবং আরও আছে শেরে বাংলা ফজলুল হক হলের মূল আবাসিক ভবনটি।

হলের ঠিক উল্টো দিকের রাস্তার অন্য পাশেই রয়েছে শিশু একাডেমি ভবন এবং আছে দেশের ঐতিহ্যবাহী দোয়েল চত্বর। হলের সামনেই বড় খোলা জায়গা। যেখানে আছে সবুজ ঘাসের সমারোহ। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ছাড়াও এখানে অনেকেই বন্ধু ও পরিবার পরিজন নিয়ে ঘুরতে আসেন। আর জায়গাটির সৌন্দর্য সত্যি মন কেড়ে নেওয়ারই মত। 

কার্জন হল কিভাবে যাবেন 

কার্জন হল(Curzon Hall) দেখতে হলে অবশ্যই আপনাকে ঢাকায় আসতে হবে। এজন্য আপনি আপনার নিজ জেলা থেকে রেল, লঞ্চ অথবা বাসে করে আসতে পারবেন। ঢাকায় আসার পর সিএনজি অথবা বাসে করে আপনাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আসতে হবে।

এবং তারপর আপনি পৌঁছে যাবেন কার্জন হল। তবে আপনি চাইলে সরাসরি প্রাইভেট কার ভাড়া করেও আপনার নিজ জেলা থেকে এখানে আসতে পারবেন। যে কোন রাস্তা ধরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আসা যাবে, তবে শাহবাগ দিয়ে আসলে সুবিধা হবে।

আরও পড়ুনঃ রেডিয়েন্ট ফিস ওয়ার্ল্ড, কক্সবাজার

কোথায় থাকবেন 

কার্জন হল দেখতে হলে যেহেতু আপনাকে আগে ঢাকায় আসতে হবে। তাই আপনি চাইলে ঢাকার মধ্যে কোন একটি হোটেলে উঠতে পারবেন। ঢাকা থেকে আপনি এক দিনেই কার্জন হল ঘুরে আসতে পারবেন। আপনি চাইলে আপনার নিজ জেলা থেকে একদিনই ঢাকা এসে ঐতিহাসিক  হল ঘুরে দেখতে পারবেন এবং রাতে আবার রওনা দিয়ে দিতে পারবেন।

আর যদি হল ছাড়াও ঢাকার আরো বেশ কিছু স্থাপনা ও দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখতে চান তবে আপনি ঢাকায় যে কোন একটি হোটেলে উঠতে পারেন। সে ক্ষেত্রে আপনি যদি এসি রুম করা হোটেল গুলো বুক করেন তাহলে আপনার একটু বেশি খরচ হবে।

আর যদি কম খরচে থাকতে চান তবে বেশ কিছু নিম্নমানের হোটেলে রয়েছে চাইলে সেখানেও উঠতে পারেন। তবে যাদের মোটরসাইকেল আছে তারা খুব সহজেই এখানে আসতে পারবে, এবং ঘুরে আবার চলেও যেতে পারবে।

খরচ কেমন হবে 

আসলেই খরচটি নির্ভর করবে শুধুমাত্র আপনার উপর। কারণ আপনার নিজ জেলা থেকে আপনি যদি বাস, লঞ্চ কিংবা, ট্রেনে করে আসেন সেক্ষেত্রে খরচটা তার উপর নির্ভর করবে। তাছাড়া আপনি ঢাকায় এসে কেমন হোটেলে থাকছেন কি কি মানের খাবার খাচ্ছেন সে সবকিছু নির্ভর করবে আপনার উপর। তাই এক্ষেত্রে বলা যায় খরচটা কেমন হবে তা নির্ভর করবে আপনার উপরেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশে আর যা যা দেখবেন

আপনার হাতে যদি সময় থাকে তাহলে আপনি রোজ গাডেন, আহসান মঞ্জিল, শহিদ মিনার, মেডিক্যাল কলেজ, দোয়েল চত্তর, সরোয়াদি উদ্যান, চারুকলা ইনস্টিটিউট, জাতীয় জাদুঘর, লালবাগ কেল্লা সহ আরও অনেক স্থান। এছাড়াও টি এস সি তে কাটিয়ে যেতে পারেন একটি বিকাল, আপনার প্রিয় মানুষটির সাথে অথবা বন্ধু-বান্ধব এর সঙ্গে। আশা করি ভালো লাগবে। 

শেষ কথা 

কার্জন হল স্থানটি সত্যি মন কেড়ে নেওয়ার মতো একটি স্থান। যারা এখনো পর্যন্ত ঐতিহাসিক কার্জন হল(Curzon Hall) দর্শণ করতে আসেননি আমি বলব আপনারা আসুন। বিশেষ করে বাচ্চাদেরকে সাথে নিয়ে আসুন, যেহেতু এই হলটি বেশ পুরনো, তাই এটি আমাদের ঐতিহ্যকে বহন করে চলেছে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য কেমন ছিল তা দেখাতে হলে তা জানাতে হলে অবশ্যই এই হল পরিদর্শন করুন

আর শীতের বিকেলে আপনার প্রিয় মানুষটির সাথে আসতেই পারেন কার্জন হলে। খেতে পারেন এক কাপ চা। অথবা বন্ধু-বান্ধব মিলে এখানে এসে দিতে পারেন একটি আড্ডা, করতে পারেন একটি গোল বৈঠক। সুসজ্জিত বাগান, সবুজের সমারোহ শান্ত প্রকৃতির এই হল আপনার সারাদিনের কাজের ক্লান্তিকে অবশ্যই মিটিয়ে দিতে পারে। তাই আজই ঘুরতে আসুন এই ঐতিহাসিক কার্জন হলে।

আরও পড়ুন-

বায়েজিদ বোস্তামী মাজার – চট্টগ্রাম

চাঁদপুরের দর্শনীয় স্থান

মন্তব্য করুন