কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত

কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত

কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত পৃথিবীর দীর্ঘতম অখন্ডিত সমুদ্র সৈকত। ১২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য বিশিষ্ট সমুদ্র সৈকতের বৈশিষ্ট্য হলো পুরো সমুদ্র সৈকতটি বালুকাময়, কাদার অস্তিত্ব পাওয়া যায় না।

বালিয়াড়ি সৈকত সংলগ্ন শামুক, ঝিনুক নানা প্রজাতির প্রবাল সমৃদ্ধ বিপণী বিতান, অত্যাধুনিক হোটেল, কটেজ, নিত্যসব সাজে সজ্জিত বার্মিজ মার্কেট সমূহ পর্যটকদের বিচরণে কক্সবাজার শহর পর্যটন মৌসুমে প্রানঞ্চল্য থাকে।

সুইজারল্যান্ড “New Seven Wonderers Foundation” এর নামীয় বারনার্ড ওয়েবার এর ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিশ্বের প্রাকৃতিক নতুন সপ্তাশ্চর্য নির্বাচন প্রতিযোগিতায় কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতটি (cox bazar sea beach) কয়েকবার শীর্ষ স্থানে ছিল।

কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত (cox bazar sea beach) একটি মায়াবী ও রূপময়ী সমুদ্র সৈক কক্সবাজার বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত একটি শহর, মৎস্য বন্দর এবং পর্যটন কেন্দ্র। এটি চট্টগ্রাম বিভাগের কক্সবাজার জেলার সদর দপ্তর।

এখানে রয়েছে বিশ্বের দীর্ঘতম অবিচ্ছিন্ন প্রাকৃতিক বালুময় সমুদ্র সৈকত, যা ১২২ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। এখানে রয়েছে বাংলাদেশের বৃহত্তম সামুদ্রিক মৎস্য বন্দর এবং সাবমেরিন ক্যাবল ল্যান্ডিং স্টেশন। একসময় কক্সবাজার পানোয়া নামেও পরিচিত ছিল, যার আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে হলুদ ফুল। এর আরও একটি প্রাচীন নাম হচ্ছে পালঙ্কি।

আরও পড়ুনঃ নাপিত্তাছড়া ঝর্ণা – চট্টগ্রাম

কক্সবাজারের ইতিহাস

নবম শতাব্দীর গোড়ার দিক থেকে ১৬১৬ মুঘল অধিগ্রহণ এর আগে পর্যন্ত কক্সবাজারসহ চট্টগ্রামের একটি বড় অংশ আরাকান রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। মুঘল সম্রাট শাহসুজা পাহাড়ি রাস্তা ধরে আরাকান যাওয়ার পথে কক্সবাজারের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হন এবং এখানেই কেম্প স্থাপনের আদেশ দেন।

কক্সবাজার নাম এসেছে ক্যাপ্টেন হীরাম কক্স নামে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক অফিসারের নাম থেকে। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অধ্যাদেশ, ১৭৭৩ জারি হওয়ার পর ওয়ারেন্ট হোস্টিং বাংলার গভর্নর হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন। তখন হিরাম কক্স পালঙ্কি মহাপরিচালকে নিযুক্ত হন।

ক্যাপ্টেন কক্স আরাকান শরণার্থী এবং স্থানীয় রাখাইনদের মধ্যে বিদ্যমান হাজার বছরের পুরনো সংঘাত নিরসনের চেষ্টা করেন। পুনর্বাসনে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি সাধন করেন কিন্তু কাজ পুরোপুরি শেষ করার আগেই মারা (১৭৯৯) যান। তার পুনর্বাসন অবদানকে স্মরণীয় করে রাখতে একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং এর নাম দেয়া হয় কক্স সাহেবের বাজার। কক্সবাজার থানা প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৫৪ সালে এবং পৌরসভা গঠিত হয় ১৮৬৯ সালে।

কক্সবাজারে (cox bazar sea beach) বিভিন্ন উপজাতি বা নি-তান্ত্রিক জনগোষ্ঠী বাস করে। এইসব উপজাতিদের মধ্যে চাকমা সম্প্রদায় প্রদান। কক্সবাজার শহর ও এর অধীনে অবস্থিত রামুতে রয়েছে বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের পবিত্র তীর্থস্থান হিসেবে বৌদ্ধমন্দির। কক্সবাজার শহরের যে মন্দিরটি রয়েছে তাতে বেশ কিছু দুর্লভ বৌদ্ধ মূর্তি আছে।।

এই মন্দিরও মূর্তিগুলো পর্যটকদের জন্য অন্যতম আকর্ষণ ও কেন্দ্রবিন্দু। কক্সবাজারের শুধু সমুদ্র আছে বাকখালি নামে একটি নদীও। এই নদীটি শহরের মৎস্য শিল্পের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের কক্সবাজার সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর স্থান হিসেবে বিখ্যাত।

কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত Coxbazzar Sea Bech
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত

আরও পড়ুন- মহামায়া লেক, চট্টগ্রাম

কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের দর্শনীয় স্থানসমূহ 

সমুদ্র দেখতে বাঙালি মাত্রই ছুটে যান কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে। বিভিন্ন বয়সের বিভিন্ন মানুষ এখানে ভ্রমণ করতে আসেন, সমুদ্রে গোসল করতে আসেন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে। কক্সবাজারের সৈকতের অংশগুলো হল– লাবনী পয়েন্ট, কলাতলী পয়েন্ট, সুগন্ধা পয়েন্ট, দরিয়ানগর সৈকত, হিমছড়ি, ইনানী সৈকত এবং টেকনাফ সৈকত।

লাবনী পয়েন্ট

বাংলাদেশের সমুদ্র সৈকত বললে প্রথমেই চোখে ভেসে ওঠে পুরাতন সী বিচ, যা লাবনী পয়েন্ট হিসেবেও পরিচিত। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কক্সবাজারগামী বাসে করে কলাতলী সী বিচ রোডে নেমে রিকশা অথবা পায়ে হাটা পৌঁছে যেতে পারবেন এই বীচে।

কক্সবাজার শহর থেকে নৈকট্যের কারণে লাবনী বীচকে কক্সবাজারের প্রধান সমুদ্র সৈকত (cox bazar sea beach) বলে বিবেচনা করা হয়। নানা রকম জিনিসের সাথে সাজিয়ে সৈকত সংলগ্ন এলাকায় রয়েছে ছোট বড় অনেক দোকান, যা পর্যটকদের আকর্ষণ করে। এছাড়া এখানে পর্যটকদের জন্য গড়ে উঠেছে ঝিনুক মার্কেট।

কলাতলী পয়েন্ট

কলাতলী বিচ কক্সবাজারের আরেকটি পর্যটন আকর্ষণ কেন্দ্র। এটা কক্সবাজারের মধ্যে অবস্থিত। বিভিন্ন বয়সের বিভিন্ন মানুষ এখানে ভ্রমণ করতে আসেন, সমুদ্রে গোসল করতে আসেন। কলাতলী বিচে নানা ধরনের খাবারের রেস্টুরেন্টসহ আরো অনেক পর্যটন সুবিধা রয়েছে।

বিশেষ করে চাঁদনী রাতে বীচে হাটা সত্যিই খুব রোমাঞ্চকর সকল বয়সী মানুষের জন্য। কক্সবাজার গ্রামের সকল যানবাহন শহরের কলাতলী পয়েন্ট দিয়ে শহরে প্রবেশ করে।

সুগন্ধা পয়েন্ট

কলাতলী পয়েন্ট থেকে দূরে উত্তর দিকে সুগন্ধা পয়েন্ট অবস্থিত। এখানে অবস্থিত জনপ্রিয় বার্মিজ মার্কেট। অতীতে এখানে অনেক সামুদ্রিক মাছের তৈরি খাবারের রেস্টুরেন্ট ছিল। সুগন্ধা পয়েন্টে রয়েছে আরেক আকর্ষণ ঝুলন্ত রেস্টুরেন্ট।

দরিয়ানগর সৈকত

হিমছড়ি জাতীয় পার্কের কাছে দরিয়ানগর সৈকত অবস্থিত। দরিয়া নগর সৈকতের মধ্য দিয়ে জলপথ প্রবাহিত হয়ে থাকে। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে প্যারাসেলিং এর জন্য দরিয়ানগর সৈকত জনপ্রিয়।

হিমছড়ি

কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত থেকে মাত্র ১২ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত হিমছড়ি পর্যটন কেন্দ্র। পাহাড়ের কুল ঘেসে এ সমুদ্র সৈকতের নাম হিমছড়ি। এখনকার সমুদ্র সৈকতটি কক্সবাজারের চেয়ে অপেক্ষাকৃত নির্জন ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। এর সৌন্দর্য কোন অংশে কম নয়। সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো হিমছড়ি যত সুন্দর তার চাইতে সুন্দর ও রোমাঞ্চকর হলো কক্সবাজার থেকে এ সৈকতে যাওয়ার পথটি।

একপাশে রয়েছে সমুদ্রে বালুময় বেলা আর এক পাশে সবুজ পাহাড়ের সারি। মাঝে পিচ ঢালা মেরিন ড্রাইভ। এমন দৃশ্য সম্ভবত দেশের আর কোথাও পাওয়া যাবে না। কেউ কক্সবাজার এলো অথচ এই পথ ধরে জুটলো না তার পুরো ভ্রমণি মাটি। পাহাড়ে উঠলে চোখের সামনে বাষ্পের নীল দিগন্তে হারিয়ে যাওয়া বিশাল সমুদ্র।

হিমছড়ির প্রধান আকর্ষণ এখানকার ক্রিসমাস ট্রি। সম্প্রতি হিমছড়িতে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু পর্যটন কেন্দ্র ও পিকনিক স্পট।

আরও পড়ুনঃ নিকলী হাওর, কিশোরগঞ্জ

ইনানী সৈকত

ইনানী সৈকত ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ (১১- মাইল), যা কক্সবাজার জেলার উখিয়া উপজেলায় অবস্থিত। এটি কক্সবাজার শহর থেকে প্রায় ২৮ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। এই সৈকতে রয়েছে সবুজ ও কালো বর্ণের অনেক প্রবাল পাথর।

টেকনাফ সৈকত

কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলায় টেকনাফ সৈকত অবস্থিত। এই অংশটা কক্সবাজারের অন্যান্য অংশ থেকে ভিন্নতার। গাছগাছালীতে পরিপূর্ণ টেকনাফ ম্যানগ্রোভের তীরে অবস্থিত টেকনাফ সৈকত। এই সৈকত বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত।

উল্লেখযোগ্য ভাগগুলো হল–

  • শ্যামলাপুর সৈকত
  •  শিলাখালি সৈকত 
  • হাজামপাড়া সৈকত

কিভাবে যাবেন

কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত যাওয়া যায় – ঢাকা থেকে কক্সবাজারে সড়ক, রেল এবং আকাশপথে যাওয়া যায়। ঢাকা থেকে কক্সবাজারগামী বাসগুলোর মধ্যে সৌদিয়া, গ্রীন লাইন, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, শ্যামলী পরিবহন, সোহাগ পরিবহন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। বাসগুলোর প্রতি সিটের ভাড়া ১,১০০ টাকা থেকে ২,৭০০ টাকা পর্যন্ত।

এছাড়াও বাংলাদেশ বিমান, ইউ এস বাংলা এয়ারলাইন্স ঢাকা থেকে সরাসরি কক্সবাজার ফ্লাইট পরিচালনা করে থাকে।

কোথায় থাকবেন

কক্সবাজার হোটেল গুলোর বর্তমান ধারণা ক্ষমতা প্রায় ১,৫০,০০০ জন। তাই অফ সিজনে বুকিং করে না গেলেও হোটেলে রুম পাবার নিশ্চয়তা থাকে। কিন্তু ডিসেম্বর এবং জানুয়ারি মাসে আগে থেকে বুকিং করে যাওয়াই শ্রেয়। কেননা এ সময় যাত্রীদের আনাগোনা বেশি থাকে।

শেষ কথা

পৃথিবীর সব থেকে দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত আমাদের কক্সবাজার। পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার নিয়ে বাঙালির গর্বের শেষ নেই। প্রতিবছর লাখো বিদেশি পর্যটক এখানে বেড়াতে আসেন। অথচ বাংলাদেশী হয়ে আমরা এর কদর করতে পারি না। 

কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত মনোমুগ্ধকর একটি জায়গা। প্রত্যেকের জীবনে অন্তত একবার হলেও কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত ভ্রমন করা উচিত। কেননা প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য আমরা নিজের ঘরের পাশে থাকতেও দেখতে পারিনা। আমাদের আজকের পোস্টে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত সম্পর্কিত সকল তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আশা করি আপনাদের ভালো লাগবে।

কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন ও তার উত্তর / FAQ’s

১. সমুদ্র সৈকত বলতে কি বুঝায়?

উত্তর:- সমুদ্র সৈকত বা সৈকত হচ্ছে এক প্রকার ভূ-তাত্ত্বিক স্থলভাগ, যা কোনো জলভাগের পার্শ্বে গড়ে ওঠে। কিন্তু হ্রদ বা হাওড় ধরনের জলাশয়ের পার্শ্বে গড়ে ওঠা স্থলভাগকে সৈকত হিসেবে ধরা হয় না।

২. বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কোনটি? 

উত্তর:- বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারে, কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত। বাংলাদেশের কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের অমালিন দৃশ্য উভয়ই উপভোগ করা যায়। 

৩. কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত কোথায় অবস্থিত? 

উত্তর:- বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত একটি শহর কক্সবাজার, মৎস্যবন্দর ও পর্যটন কেন্দ্র। এটি চট্টগ্রাম বিভাগের কক্সবাজার জেলার সদর দপ্তর। তার নৈসর্গিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত কক্সবাজার। 

৪. সমুদ্রে কত গ্যালন পানি থাকে? 

উত্তর:- সমুদ্রে প্রায় ৩৫২ কুইন্টিলিয়ন গ্যালন পানি রয়েছে যা নদী থেকে পানি সমুদ্রে প্রবেশ করে। এবং বরফ গলিয়ে বাষ্পীভবনের মাধ্যমে সমুদ্রকে বায়ুমন্ডলে ছেড়ে দেয়। 

৫. শৈবাল সাগর বলতে কি বুঝায়? 

উত্তর:- শৈবাল সাগর হচ্ছে সমুদ্রের মাঝে শ্রোতহীন অঞ্চল, যেখানে শৈবাল ও অন্যান্য আগাছা জন্মায়। এটাই পৃথিবীর একমাত্র সাগর যার কোনো উপকূল নেই। এটার দৈর্ঘ্য প্রায় ৩,২০০ কিলোমিটার এবং প্রশস্ত ১,১০৭ কিলোমিটার। 

আরও পড়ুন-

ফয়েজ লেক – চট্টগ্রাম

চাঁদপুরের দর্শনীয় স্থান

মন্তব্য করুন