ছেড়া দ্বীপ
ছেড়া দ্বীপ হলো সেন্টমার্টিন এর সর্ব দক্ষিণে অবস্থানরত দেশের একটি সেরা মানের দর্শনীয় স্থান। ‘ছেঁড়াদিয়া’ বা ‘সিরাদিয়া’ সহ এই দ্বীপের অসংখ্য নাম রয়েছে। তবে স্থানীয়রা এই দ্বীপকে ‘সিরাদিয়া’ হিসেবে ডাকতে বেশ পছন্দ করে। দ্বীপটি অতটা বড় না হলেও খু্ব ছোট নয়।
এই দ্বীপ আয়তনের দিক দিয়ে প্রায় ১০০ থেকে ৫০০ বর্গমিটারের মতো। বলে রাখা ভালো এর নামের শেষে দ্বীপ থাকলেও এটি কিন্তু কোনো দ্বীপ নয়। বরং এটি একটি দ্বীপপুঞ্জ। আর এর নাম ছেড়া দ্বীপ হওয়ার কারণ হলো এটি অন্যান্য দ্বীপের চাইতে দূরত্বের বা অবস্থানের দিক দিয়ে বেশ আলাদা একটি দ্বীপপুঞ্জ।
এর অবস্থান বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণ দিকে। এই ছেড়া দ্বীপ ছাড়া বাংলাদেশের দক্ষিণে আপনি আর কোনো কেন্দ্র পাবেন না। মনে রাখবেন এই স্থানটির সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করলেও এখানে উপভোগের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন জরুরি। কারণ দ্বীপের প্রায় অর্ধেকই নির্দিষ্ট সময়ে ডুবে থাকে।
বিশেষ করে জোয়ারের সময় এটি ভয়ংকর আকার ধারণ করে। সুতরাং এই সময়টাতে যদি কেউ ছেড়া দ্বীপ উপভোগের কথা ভাবে সেক্ষেত্রে তাকে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। জোয়ারের সময় লঞ্চের ব্যবস্থা থাকলেও যারা দ্বীপের মাটিতে পা রাখতে চান তারা ভাটার সময় হেঁটে হেঁটে এই দ্বীপ উপভোগ করতে পারবেন।
আরও পড়ুনঃ নিঝুম দ্বীপ নোয়াখালী
ছেড়া দ্বীপে দর্শনীয় স্থানসমূহ
ছেড়া দ্বীপ দেখতে হলে আপনাকে ভাটার সময মাথায় রেখে যেতে হবে। কারণ জোয়ারের সময় পুরো দ্বীপের অর্ধেক অংশ পানিতে ডুবে থাকে। দেখার মতো ছেড়া দ্বীপের যে বিষয়টি নিয়ে একেবারে না বললেই নয় সেটি হলো এখানে প্রচুর প্রাকৃতিক পাথর পাওয়া যায়।
তবে এসব পাথর ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক মালিকানায় রেখে কেউই ব্যবহার করতে পারবে না। আইন অনুযায়ী এখানে কোনো স্থাপনা নির্মাণ করাটাও সম্ভব নয়। এছাড়াও ছেড়া দ্বীপের আকর্ষণীয় দিকগুলি হলো এখানে থাকা প্রবাল, শামুক, ঝিনুক, কুড়ি, প্রবাল পাথর ও কেয়া বন। যারা সকালে এই দ্বীপে যাওয়ার প্ল্যান করছেন তারা সেই সময়টাতে লোকারণ্য ও মেলার মতো পরিবেশ উপভোগ করতে পারবেন।
আর যারা বিকেলের দিকে যাবেন তারা শান্ত পরিবেশ উপভোগের সুযোগ পাবেন। আর যাদের সামুদ্রিক জিনিসপত্র পছন্দ তারা বিভিন্ন পন্যের পসরা নিয়ে বসা দোকানিদের প্রোডাক্টগুলি ট্রাই করতে পারেন। আশা করি কোয়ালিটি এবং রুচিশীলতা দু’টোই আপনার পছন্দ হবে। এই দ্বীপে ট্রলারে করে ঘোরাঘুরির সুযোগও আছে। মজার ব্যাপার হলো এই দ্বীপে অতিথি পাখির সংখ্যা নেহায়েত কম নয়।
ছেড়া দ্বীপে কিভাবে যাবেন
বিভিন্ন উপায়ে আপনি ছেড়া দ্বীপে যেতে পারবেন। ঢাকা টু টেকনাফ, ঢাকা টু সেন্টমার্টিন বা ঢাকা টু কক্সবাজার! তবে বর্তমানে ছেড়া দ্বীপে যাওয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং সহজ মাধ্যম হলো ঢাকা টু কক্সবাজার, কক্সবাজার টু সেন্টমার্টিন এবং সবশেষে সেন্টমার্টিন টু ছেড়া দ্বীপ। আসুন বিস্তারিত জানি।
ঢাকা টু কক্সবাজার
সেন্ট মার্টিনের মূল অংশ থেকে কিছুটা দূরে এই ছেড়া দ্বীপ। প্রায় ২ ঘন্টা সময়ের ব্যবধানে আপনি সেন্ট মার্টিন থেকে ছেড়া দ্বীপে পৌঁছাতে পারবেন। তবে যারা ট্রলার ব্যবহার করতে চান তাদের সেন্ট মার্টিন থেকে ছেড়া দ্বীপে যেতে সময় লাগবে মাত্র ৩০ মিনিট। ছেড়া দ্বীপে যেতে হলে আপনাকে বাংলাদেশের যেকোনো জেলা থেকে সড়ক, রেল এবং আকাশপথে যেতে হবে কক্সবাজারে।
কক্সবাজারে যেতে চাইলে সৌদিয়া, এস আলম মার্সিডিজ বেঞ্জ, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, শ্যামলী পরিবহন, সোহাগ পরিবহন, এস. আলম পরিবহন, মডার্ন লাইন, গ্রিন লাইন নামের বাসগুলির সাহায্য নিতে পারেন। এই বাসগুলি আপনাকে ঢাকা টু কক্সবাজারে নিয়ে যেতে ৯০০ টাকা থেকে ২০০০ টাকার মতো চার্জ করবে।
ঢাকা টু টেকনাফ
৯০০ টাকা থেকে ২৩৫০ টাকার মধ্যেই আপনি ঢাকা থেকে টেকনাফে যেতে পারবেন। আর যারা এসি বাস করে যেতে চান তাদের ভাড়া বাবদ গুনতে হবে ১২০০ টাকা থেকে ২৩৫০ টাকার মতো। যেহেতু ঢাকা থেকে সেইন্টমার্টিন যাওয়ার কোন সরাসরি বাস নেই সেহেতু শুরুতে ঢাকা টু টেকনাফে নিয়ে টেকনাফ টু সেন্টমার্টিনে যেতে পারবেন।
আর টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিনে যেতে হলে আপনাকে ব্যবহার করতে হবে টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিনের যাওয়ার জাহাজগুলিকে। যারা টিকিট কোথায় পাবেন এ ব্যাপারে ভাবছেন তারা বাংলাদেশ ট্যুরস ওয়েবসাইট ভিজিট করে পছন্দের টিকিট কিনে নিতে পারেন।
কক্সবাজার টু সেন্টমার্টিন
এরপর কক্সবাজার থেকে সোজা ছেড়া দ্বীপে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। আপনি চাইলে হেঁটে যেতে পারেন, আবার ট্রলারে করেও যেতে পারেন। যদি হেঁটে যেতে ১ ঘন্টার মতো সময় লাগে সেক্ষেত্রে ট্রলারে যেতে সময় লাগবে মাত্র ২০/৩০ মিনিট। তবে যখন ছেড়া দ্বীপে জোয়ার চলে তখন হাঁটার কোনো সুযোগ থাকে না। অগত্যা ব্যবহার করতে হয় ট্রলার। বলে রাখা ভালো কক্সবাজার থেকে সেন্টমার্টিনে যেতে কতৃপক্ষ বিভিন্ন জাহাজ কিংবা নৌযানের ব্যবস্থা রেখেছে।
সেন্টমার্টিন টু ছেড়া দ্বীপ
আর সেন্টমার্টিন থেকে ছেড়া দ্বীপে যেতে রাখা হয়েছে বিভিন্ন ট্রলারের ব্যবস্থা। এক্ষেত্রে আরো একটি টিপস জানিয়ে রাখি। আপনি যদি ট্রলারে চড়ে ছেড়াদ্বীপে যেতে চান সেক্ষেত্রে যাওয়ার সময় সেন্টমার্টিনের পুরো ভিউটাই উপভোগ করতে পারবেন। শুরুতেই ট্রলার ভাড়ার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে তবে ট্রলারে উঠে পড়ুন। তবে ছেড়াদ্বীপের পাশে আপনি কখনোই ট্রলার ভেড়াতে পারবেন না। এক্ষেত্রে ছোট ডিঙ্গি নৌকাগুলোকেই ব্যবহার করতে হবে।
ছেড়া দ্বীপ ভ্রমণে থাকা-খাওয়া
ছেড়া দ্বীপে ভ্রমণের ক্ষেত্রে ভোর রাতে বের হলে দিনে দিনে ফিরে যেতে পারবেন। তবে যদি থাকতেই হয় সেক্ষেত্রে সেন্টমার্টিনে স্থাপন করা বিভিন্ন হোটেল বা কটেজে উঠে পরতে পারেন। এখানে বেশকিছু ভালো হোটেল এবং কটেজের ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং এদের সার্ভিসও বেশ সন্তোষজনক।
এখানে ভালো এবং তুলনামূলক কম ভালো ২ ধরণের হোটেল পাবেন। এক্ষেত্রে বাজেট রাখতে হবে ৩০০ টাকা থেকে শুরু করে ৪০০০ টাকা পর্যন্ত। তাছাড়া বিভিন্ন মৌসুম অনুযায়ী এসব হোটেলের ভাড়া উঠানামা করে। বিশেষ করে শীতের মৌসুমে এখানকার হোটেল বা কটেজের ভাড়া থাকে অনেক বেশি। আর খাবার-দাবারের ক্ষেত্রে এই ছেড়া দ্বীপে আপনি বেশকিছু ছোট ছোট দোকান পাবেন।
যেখানে ডাব, তরমুজ এবং চাসহ হালকা-পাতলা খাবারদাবার সেল করা হয়ে থাকে। ঘোরাঘুরির ক্ষেত্রে হালকা খাবার হিসাবে এসব খাবারই বেস্ট। তাছাড়া ছেড়া দ্বীপে থাকা বিশেষ একটি দোকান প্রতিটি পর্যটকদের জন্য লিমিটেড প্রাইজে বিভিন্ন আইটেমের জুস ও পানি এবং দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করে থাকে।
চাইলে তাদের সার্ভিসও গ্রহণ করতে পারেন। আর ছেড়া দ্বীপ ভ্রমণের কোনো এক ব্রেকে আপনি এই দ্বীপের কাকড়া আর ফ্লায়িং ফিস ফ্রাইয়ের অসাধারণ স্বাদ গ্রহণ করতে পারেন।
ছেড়া দ্বীপ ভ্রমণের বাড়তি টিপস
বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণ দ্বীপ সেন্টমার্টিনের অংশ ছেড়া দ্বীপ ভ্রমণের ক্ষেত্রে বেশকিছু টিপস ফলো করা চাই। যা আপনার ভ্রমণকে আরো বেশি অর্থবহ করে তুলবে। এক্ষেত্রে:
- ট্রলার ছাড়াও সেন্ট মার্টিন টু ছেড়া দ্বীপ যেতে স্পীড বোর্ড ব্যবহার করতে পারেন
- ট্রলারে চড়ে ছেড়াদ্বীপে যাওয়ার সময় সেন্ট মার্টিন দ্বীপের সৌন্দর্য উপভোগ করতে ভুলবেন না
- ভোরে বের হলে অনেকক্ষণ ঘোরার সুযোগ পাবেন এবং একইসাথে নারকেল গাছ বেষ্টিত সেন্ট মার্টিনের সৌন্দর্যও উপভোগ করতে পারবেন
- বর্তমানে অন্যান্য যানের পাশাপাশি সেন্টমার্টিনে সাইকেলও ভাড়া পাওয়া যায়
- কোনো কারণে বালিয়ারি ধরে সাইকেল চালিয়ে যাওয়াকে কঠিন মনে হলে হেঁটে যেতে পারেন
- যারা একেবারে ছেড়া দ্বীপ ঘেসে নামতে চান তারা ট্রলার ব্যবহারের পরিবর্তে ছোট ডিঙ্গি নৌকাগুলোর সাহায্য নিতে পারেন
- ছেড়া দ্বীপ ভ্রমণের সময় এর প্রবাল, সাদা, কালো হরেক রং হরেক ডিজাইন উপভোগ করতে ভুলবেন না
- উপভোগের অংশ হিসাবে কখনোই ধারালো প্রবালের উপর দিয়ে সাগরে নামার কোনো চেষ্টা করবেন না
- দামদর করার পর পছন্দের কাঁকড়া টেস্ট করতেও ভুলবেন না
শেষ কথা
কেওড়া গাছ, সমুদ্র, পানি, নীল আকাশ, প্রবাল, শামুক, ঝিনুক, কুড়ি, প্রবাল পাথর এবং বনের সমন্বয়ে ছেড়া দ্বীপ যেনো হয়ে উঠেছে পৃথিবীর এক টুকরো স্বর্গপুরি। তবে এই দ্বীপ ভ্রমণের সময় হিসাবে কোনোভাবেই রাতের সময়টিকে বাছাই করা যাবে না। পাশাপাশি শীতের মৌসুমে যদি এখানে বেড়াতে আসেন সেক্ষেত্রে অন্যান্য সময়ের চাইতে তুলনামূলক ভালোই উপভোগ করার সুযোগ পাবেন।
পাশাপাশি এখানকার অতিথির পাখির প্রতিও পর্যটক হিসাবে আপনাকে যথেষ্ট সৎ এবং হৃদয়বান হতে হবে। বিশেষ করে পাখি শিকার করাটা যাদের পেশা তারা এই দ্বীপে কোনোভাবেই পাখি হত্যার মতো জঘন্য কাজটি করার সুযোগ পাবেন না। সবশেষে বলবো ট্রলার, সাইকেল, বাস, হোটেল, কটেজ কিংবা খাবার…যা-ই বুক করেন না কেনো আগে থেকেই দাম নিয়ে কথাবার্তা বলে নেবেন।
ছেড়া দ্বীপ সম্পর্কিত প্রশ্ন ও উত্তর / FAQ
১. ছেড়া দ্বীপের অপর নাম কি?
উত্তরঃ ছেড়া দ্বীপের অপর নাম হলো ছেঁড়াদিয়া বা সিরাদিয়া।
২. ছেড়া দ্বীপ যাওয়ার উপায় কি?
উত্তরঃ ছেড়া দ্বীপ যাওয়ার উপায় হলো ঢাকা টু কক্সবাজার, কক্সবাজার টু সেন্টমার্টিন এবং সবশেষে সেন্টমার্টিন টু ছেড়া দ্বীপ।
৩. ছেড়া দ্বীপের আয়তন কত?
উটরঃ ছেড়া দ্বীপের আয়তন মূলত প্রায় ৫০০ বর্গমিটার।
৪. ছেড়া দ্বীপ কোথায় অবস্থিত?
উত্তরঃ ছেড়া দ্বীপের অবস্থান হলো বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণে অর্থ্যাৎ কক্সবাজারে সেন্টমার্টিনের আরো ভেতরে।
৫. সেন্টমার্টিন থেকে ছেড়া দ্বীপের দুরত্ব কতটুকু?
উত্তরঃ সেন্টমার্টিন থেকে ছেড়া দ্বীপের দূরত্ব হলো মাত্র ৫ কিলোমিটার।
আরও পড়ুন-
ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর
শালবন বিহার, কুমিল্লা