বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান – এক বীর মুক্তিযোদ্ধা

বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান 

বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান একজন মহান মুক্তিযোদ্ধা। তিনি 1971 সালে বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহত ও শহীদ হন। বাংলাদেশের ১৯৭১ সালের  মুক্তিযুদ্ধে যে সাতজন চরম সাহসিকতা এবং বীরত্ব দেখিয়েছেন তার স্বীকৃত স্বরূপ  সর্বোচ্চ সম্মান বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে  ভূষিত হয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলো ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট  মতিউর রহমান।

আমাদের আজকের এই আর্টিকেলের আলোচিত বিষয় হলো বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান এর জীবনী, মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা, সমাধিসহ জীবন বৃত্তান্ত। আশা করি একটি ভাল সময় উপভোগ করবেন এই মহান নায়কের সঙ্গে।

বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান এর পরিচিতি

বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান
জন্ম ১৯৪১ সালের ২৯ অক্টোবর, ঢাকা, ব্রিটিশ ভারত 
মৃত্যু ১৯৭১ সালের ২০ আগস্ট, থাট্টা, পশ্চিম পাকিস্তান 
আনুগত্য বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের মার্চ হতে, পাকিস্তান ১৯৭১ সালের মার্চ পর্যন্ত 
পদমর্যাদা ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট 
সার্ভিস নাম্বার পাক-৪৩৬৭
যুদ্ধ পাকিস্তান ভারত যুদ্ধ ১৯৬৫, ১৯৭১ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ 
পুরস্কার বীরশ্রেষ্ঠ 
স্ত্রী মিলি রহমান 
 

জন্ম ও শিক্ষাজীবন 

বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান ২৯ অক্টোবর, ১৯৪১ সালে, ঢাকার ১০৯ আগা, সাদেক রোডে এর পৈত্রিক বাড়ি মোবারক লজে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক নিবাস ছিল নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানার রামনগর গ্রাম। মতিউর রহমান ছিলেন নয় ভাই ও দুই বোনের মধ্যে ষষ্ঠ।

তার বাবা ছিলেন মৌলভী আব্দুস সামাদ এবং মা সৈয়দা মোবারকুন্নেছা খাতুন। তিনি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল হতে পাস করেছেন। এরপর ভর্তি হয়েছেন পাকিস্তান বিমান বাহিনী পাবলিক স্কুলে। 

মেট্রিক পরীক্ষায় ডিস্টিংকশনসহ সাফল্যের সঙ্গে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছেন। বিমান বাহিনীতে যোগ দিয়েছেন ১৯৬১ সালে।  ১৯৬৩ সালের জুন মাসে কমিশন লাভ করেন রিসালপুর পি,এ,এফ কলেজ থেকে এবং নিযুক্ত হন  জেনারেল ডিউটি পাইলট হিসেবে।

এরপর জেট কনভারশন কোর্স সমাপ্ত করেন ও পেশোয়ারে গিয়ে জেট পাইলট হন করাচির মৌরিপুরে। ১৯৬৫ সালে ভারত পাকিস্তানের যুদ্ধ যখন হয় এই সময় এর মতিউর রহমান ফ্লাইং অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এরপর কনভার্সন কোর্স করার জন্য পুনরায় সারগোদাই যান। 

তিনি ১৯৬৭ সালের ২১ জুলাইয়ে একটি মিগ-১৯ বিমান চালানোর সময়ে বিমানটি হঠাৎ করে আকাশে বিকল হয়ে যায়। সেই সময় তিনি দক্ষতার সঙ্গে প্যারাসুট যোগে অবতরণ করেন মাটিতে। ১৯৬৭ সালে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট পদে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান পদোন্নতি লাভ করেন।

পেশোয়ারে ১৯ টি অনুষ্ঠিত বিমান মহরায় ইরানের রানী ফারা দিবার সম্মানে একমাত্র বাঙালি পাইলট হিসেবে তিনি উপস্থিত ছিলেন। দুই বছর ফ্লাইং ইন্সট্রাক্টর হিসেবে রিসালপুরে কাজ করেন এরপর ১৯৭০ সালে বদলি হন জেট ফ্লাইং ইন্সট্রাক্টর হয়ে। তিনি ঢাকায় ছুটিতে বেড়াতে আসেন ১৯৭১ সালে, ফেব্রুয়ারি মাসে।

মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা 

১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে মতিউর রহমান ঢাকায় সপরিবারে আসেন দুই মাসের ছুটিতে। ২৫ মার্চ কাল রাতে তিনি নরসিংদী জেলার রায়পুরার  রামপুর গ্রামের ছিলেন। এরপর যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় পাকিস্তান বিমান বাহিনীর একজন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট হয়েও চরম সাহসিকতা ও ঝুঁকি নিয়ে ভৈরবে একটি ট্রেনিং ক্যাম্প খোলেন।

যেসব যুবকেরা যুদ্ধ করতে আগ্রহী ছিলেন তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিতে থাকেন। তিনি দৌলতকান্দিতে একটি জনসভা করেন এবং ভৈরববাজারে বিরাট মিছিল নিয়ে যান। মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন স্থান হতে অস্ত্র সংগ্রহ করেন এবং সেগুলি দিয়ে প্রতিরোধ বাহিনী গড়ে তোলেন।

পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীরা ভৈরব  আক্রমণ যখন করে তখন রেজিমেন্টে ই,পি,আর এর সাথে থেকে সেখানে প্রতিরোধ বুহ্য তৈরি করেন। ১৪ এপ্রিল 1971 সালে পাকিস্তান নিয়ে বিমান বাহিনী তাদের এফ-৮৬ স্যাবর জেট হতে তাদের ঘাটের ওপরে বোমাবর্ষণ শুরু করে। তবে মতিউর রহমান এটি পূর্বে আশঙ্কা করেছিলেন। তাই তিনি ঘাঁটি পরিবর্তন করেন এবং তিনি ও তার বাহিনী ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পান। 

মুক্তিযুদ্ধে যোগদান

এরপর ১৯৭১ সালের ২৩ শে এপ্রিল তিনি ঢাকায় আসেন এবং ৯ই মে সপরিবারে করাচি  চলে যান। কর্মস্থানে ফিরে যাওয়ার পর তিনি জঙ্গি বিমান দখল এবং মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য সিদ্ধান্ত নেন।

 সে সময় তাকে বিমানের সেফটি অফিসারের দায়িত্ব দেওয়া হয়। বিমান দখলের জন্য তিনি রাশেদ মিনহাজ নামে একুশ বছর বয়সী একজন শিক্ষানবিশ পাইলটের উড্ডয়নের দিনে (২০ই আগস্ট, ১৯৭১)  টার্গেট করেন। তার পরিকল্পনা ছিল সেইদিন মিনহাজ কন্ট্রোল টাওয়ার এর অনুমতি পেলেই তার কাছ থেকে বিমান টির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবেন।

পরিকল্পনামাফিক অফিসে এসে তিনি সিডিউল টাইমে গাড়ি নিয়ে রানওয়ের পূর্ব পাশে  চলে যান। সামনে রয়েছে দুই সিটের প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত বিমান টি -৩৩। এ সময় পাইলট রাশেদ মিনহাজ দ্বিতীয়বারের মতো বিমানটি নিয়ে একক উড্ডয়নের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। 

কন্ট্রোল টাওয়ার ক্লিয়ারেন্স এর পর বিমানটি নিয়ে মিনহাজ রানওয়েতে উড্ডায়নের প্রস্তুতি যখন নিচ্ছিলেন মতিউর রহমান সেফটি অফিসারের ক্ষমতা বলে বিমানটি থামাতে বলেন। এ সময় মিনহাজ বিমানটি থামান ও ক্যানপি খোলেন এবং বিমান কেন থামানো হলো তা জানতে চান।

মতিউর রহমান সেসময় বিমানের ককপিটে চড়ে বসেন এবং উঠেই রাশেদ মিনহাজকে ক্লোরোফরমের মাধ্যমে অচেতন করে ফেলেন। জ্ঞান হারানোর পূর্বে রাশেদ মিনহাজ কন্ট্রোলরুমে জানাতে সক্ষম হন যে তিনি সহ পুরো বিমানটি হাইজ্যাক হয়েছে।

বিমানটি ছোট পাহাড়ের আড়ালে ছিল তাই কেউ দেখতে না পেলেও মিনহাজের বার্তা শুনতে পাই কন্ট্রোল টাওয়ার অপর চার টি জঙ্গি বিমান মতিউর এর বিমানকে ধাওয়া করে। মৃত্যু সন্নিকটে জানার পরও নির্ধারিত সীমার নিচে মতিউর রহমান বিমানটি চালিয়ে রাডার ফাঁকি দেওয়ার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের আসতে চেষ্টা করেন।

মৃত্যু 

রাশেদ মিনহাজ ঠিক সে সময় জ্ঞান ফিরে পান যখন বিমানটি প্রায় ভারতের সীমান্তে পৌঁছায় এবং সে অবস্থায় তিনি বিমানটি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেন। মোটকথা তিনি চাচ্ছিলেন মতিউর রহমান এর বিমান ছিনে নেওয়ার যে পরিকল্পনা সেটি সফল হওয়ার চেয়ে বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়াই ভালো।

এ সময় মতিউরের সাথে রাশেদের ধস্তাধস্তি হয় এবং একপর্যায়ে গিয়ে রাশেদ ইজেক্ট সুইচ চাপেন। এতে করে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান বিমান থেকে ছিটকে পড়ে যান। বিমানটি বেশি উচ্চতায় উন্নয়ন করছিল না ফলে রাশেদসহ বিমানটি ভারতের সীমান্ত হতে মাত্র 35 মাইল দূরে থাট্টা এলাকাতে বিধ্বস্ত হয়। মতিউর রহমানের সঙ্গে কোন প্যারাসুট ছিল না যার কারনে তিনি নিহত হন।

তার মৃতদেহ পাওয়া যায় ঘটনা স্থল হতে প্রায় আধ মাইল দূরে। বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান তার পরিকল্পনাটি সফল করতে পারলেন না। কিন্তু স্বপ্ন দেখেছিলেন তার প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমিকে শত্রুর হাত থেকে মুক্ত করতে। তাইতো জীবন এর মায়া ভুলে রেখে গেছেন এক অবিস্মরণীয় ইতিহাস। 

১৯৭১ সালের ২০ই আগস্ট রাশেদ মিনহাজ এবং মতিউর রহমান নিজের দেশের জন্য মৃত্যুকে বরণ করেন। মতিউর রহমানের সাহসী এবং বীরত্ব মূলক  ভূমিকার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করেন এবং একইভাবে রাশেদ মিনহাজকে পাকিস্তান সরকার সম্মান সূচক খেতাবে ভূষিত করেন। কিন্তু পাকিস্তান সরকার মতিউর রহমানের  মৃত দেহ দাফন করেছেন বিশ্বাসঘাতক হিসেবে আর মিনহাজকে বানিয়ে দিয়েছেন জাতীয় বীর। হয়তো স্ব স্ব দেশের অবস্থানে তারা ঠিক। 

একটি ঘটনায় দুজনই সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী নিজেদের স্ব-স্ব অবস্থানে। তাদের এই আত্মত্যাগমূলক ভূমিকার জন্য দুইজনকেই তাদের দেশের সর্বোচ্চ সম্মানে ভূষিত হওয়ার ঘটনাটি বিরল। 

সমাধি স্থানান্তর 

মতিউর রহমানের মৃতদেহ পাকিস্তান সরকার সমাহিত করেছে করাচির মাশরুর ঘাঁটির চতুর্থ শ্রেণীর কবরস্থানে। পরবর্তীতে যখন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়, ২৪ শে জুন 2006 সালে মতিউর রহমানের দেহাব শেষ পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হয় এবং পূর্ণ মর্যাদার সাথে ২৫ শে জুন পুনরায় তাকে শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হয়। 

সম্মাননা 

বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান এর  স্মৃতিচারণায় বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর যশোর বিমান ঘাঁটি তার নামে নামকরণ হয়েছে। বিমান বাহিনী তার নামকরণে একটি ট্রফি চালু করেছে। বিমান প্রশিক্ষণে যারা সেরা কৃতিত্ব প্রদর্শন করে তাদেরকে এই ট্রফি প্রদান করা হয়।

উপসংহার 

বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান  নিজের জীবন উৎসর্গ করে দেখিয়ে দিয়েছেন মাতৃভূমির প্রতি এক নজিরবিহীন ভালোবাসা। যে ভালবাসায় সবার ঊর্ধ্বে থাকে মাতৃভূমি। তাই স্বাধীনতার ৫২ বছর পরেও আমরা সবাই তাকে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করি। পাঠ্য বই থেকে শুরু করে ইতিহাসের পাতায় সারা জীবন জ্বলজ্বল হয়ে থাকবেন অমর স্মৃতি বন্দনায়।

বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান সম্পর্কিত প্রশ্ন ও উত্তর / FAQ

১. বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের দেহাবশেষ কবে বাংলাদেশে আনা হয়? 

উত্তর: বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের মৃতদেহ ছিল করাচীর মাশরুর ঘাঁটির  চতুর্থ শ্রেণীর কবরস্থানে। তার দেহাবশেষ  পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয় ২০০৬ সালের ২৪ জুন এবং ২৫ শে জুন পূর্ণ  মর্যাদার সাথে শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হয়।

২. বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমানের বাড়ি? 

উত্তর: বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান এর বাড়ি নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানার রামনগর গ্রামে। 

৩. বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের স্ত্রীর নাম কি? 

উত্তর: বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের স্ত্রীর নাম মিলির রহমান। তাদের এক ছেলে এবং চার মেয়ে। 

৪. দেশের জন্য বিমান ছিনতাই করেছিলেন কোন বীরশ্রেষ্ঠ? 

উত্তর: স্বাধীনতা যুদ্ধে এই বীর সেনা পাকিস্তান থেকে বিমান ছিনতাই করতে চেয়েছিলেন বাংলাদেশে ব্যবহারের জন্য। ১৯৭১ সালের ২০ আগস্ট মতিউর রহমান পাইলট অফিসার সহ প্রশিক্ষণ বিমান টি ৩৩ যার সাংকেতিক নাম ব্লুবার্ড ১৬৬ ছিনতাই করে ভারতের দিকে উড্ডয়ন করেন কিন্তু পাঞ্জাবি পাইলট এর বাধার জন্য তিনি ছিনতায়ে সফল হতে পারেননি। বিমানটি বিধ্বস্ত হওয়ায় থাট্টায় এবং উভয় প্রাণ হারান। 

আরও পড়ুন-

মন্তব্য করুন