বজরা শাহী মসজিদ নোয়াখালী

বজরা শাহী মসজিদ 

মসজিদ হল মুমিন মুসলিমদের প্রাণ। বাংলাদেশ মুসলিম প্রধান দেশ। এদেশের আনাচে-কানাচে রয়েছে দৃষ্টিনন্দন অনেক মসজিদ। কিছু কিছু মসজিদ রয়েছে অনেক পুরানো, যা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে এদেশের বুকে । তেমনি এক মসজিদ হল নোয়াখালীর বজরা শাহী মসজিদ।

৩০০ বছর পুরানো এই মসজিদটি নোয়াখালী (noakhali) জেলার সোনাইমুড়ী উপজেলায় অবস্থিত। এটি নির্মাণ করা হয় ১৮’শ শতাব্দীতে মুঘল আমলে। মুঘল আমলের ঐতিহ্য বহন করে ঐতিহাসিক এই বজরা শাহী মসজিদ। বাংলাদেশের ইসলাম ধর্ম প্রচারে ঐতিহাসিক অবদান রয়েছে এই মসজিদের।

এই মসজিদের স্থাপনাশৈলী আপনাকে বিমোহিত করবে। স্থানীয় জনগণের কাছে এই মসজিদটি “বাংলাদেশের তাজমহল” নামে পরিচিতি পেয়েছে। মনোমুগ্ধকর সুনিপুণ নকশায় ভরা ঐতিহাসিক এই মসজিদ সম্পর্কে আজকে বিস্তারিত আলোচনা করব। বজরা শাহী মসজিদ শুধু নামাজের জন্য নয়, এর সৌন্দর্য দেখার জন্য প্রচুর দর্শনার্থী সমবেত হয় এই মসজিদে।

আরও পড়ুনঃ পলওয়েল পার্ক, রাঙ্গামাটি

বজরা শাহী মসজিদের ইতিহাস 

অবিভক্ত ভারতবর্ষে ৩০০ বছরেরও বেশি সময় রাজত্ব করেন দিল্লির মুঘল সম্রাটেরা। তাদের এই দীর্ঘ রাজত্বকালের সময়ে মুঘল সম্রাটগণ এবং তাদের আমলারা বিভিন্ন স্থানে অসংখ্য ইমারত, মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। তাদের নির্মাণগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল – আগ্রার তাজমহল, সেকেন্দ্রা, আগ্রার দূর্গ, দেওয়ানে আম, দিল্লীর লালকেল্লা, দিল্লীর শাহী জামে মসজিদ ইত্যাদি। 

দিল্লির বিখ্যাত জামে মসজিদের অনুকরণে তৈরি করা হয়েছে বজরা শাহী মসজিদ১১৫৪ হিজরী, ১১৩৯ বাংলা মোতাবেক ১৭৪১ সালে নির্মাণ করা হয় ঐতিহাসিক এই মসজিদ। মুঘল জমিদার আমানুল্লাহ খান এই মসজিদটি নির্মাণ করেন।

যা আজও মুঘল স্থাপত্য শিল্পের অন্য নিদর্শন হিসেবে দেশি-বিদেশী দর্শনার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আসছে। ইতিহাস থেকে জানা যায়, জমিদার আমানুল্লাহ ১৭৪১-৪২ সালে ৩০ একরের একটি জমিতে খনন করেন বিশাল এক দিঘী। তিনি এই দীঘির পাশেই নির্মাণ করেন আকর্ষণীয় বজরা শাহী মসজিদ। 

মুঘল সম্রাট মোহাম্মদ শাহ এর অনুরোধে সৌদি আরবের পবিত্র কাবা শরীফ হতে মাওলানা শাহ আবু সিদ্দীক এই মসজিদের প্রথম ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেছিলেন। মাওলানা শাহ আবু সিদ্দীক সাহেবের বংশধরগণ যুগ যুগ ধরে মসজিদটির ইমামের দায়িত্ব পালন করে চলছেন। বর্তমানে বজরা শাহী মসজিদ এর ইমাম হিসেবে নিযুক্ত আছেন শাহ আবু সিদ্দিক সাহেবের সপ্তম পুরুষ ইমাম হাসান সিদ্দীকি। 

নির্মাণ করার প্রায় ১৭৭ বছর পর ১৯০৯ সালে একবার মেরামত করা হয় মসজিদটি। এরপর ১৯১১ সাল থেকে ১৯২৮ সালের মধ্যে জমিদার খান বাহাদুর আলী আহমদ এবং খান বাহাদুর মুজিব উদ্দিন আহমদ বজরা শাহী মসজিদ এর ব্যাপকভাবে মেরামত করেছিলেন। বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ১৯৯৮ সালের ২৯ নভেম্বর থেকে সুদর্শন বজরা শাহী মসজিদের ঐতিহ্য রক্ষা এবং দুর্লভ নিদর্শন সংরক্ষণ করার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। 

বজরা শাহী মসজিদের অবস্থান 

১৮’শ শতাব্দীতে নির্মিত বজরা শাহী মসজিদ অবস্থিত নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ী উপজেলার বজরা ইউনিয়নে। নোয়াখালীর মাইজদী প্রধান শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার উত্তরে সোনাইমুড়ী থানার বজরা নামক স্থানে প্রধান সড়কের পশ্চিম পাশে অবস্থিত বিখ্যাত বজরা শাহী মসজিদ।

নোয়াখালী (noakhali) জেলার ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর মধ্যে এই মসজিদটি অন্যতম। মুঘল আমলের ঐতিহ্য বহনকারী ঐতিহাসিক এই মসজিদ দেখার জন্য প্রতিদিন অনেক অনেক দর্শনার্থীরা ভীড় জমায়। নোয়াখালীসহ সমগ্র বাংলাদেশে ইসলাম ধর্ম প্রচারে ঐতিহাসিক অবদান রয়েছে এই মসজিদের। 

বহু দূর-দূরান্ত থেকে মানুষজন এসে নামাজ আদায় করেন বজরা শাহী মসজিদ প্রাঙ্গণে। মহিলারাও নামাজ পড়ার সুযোগ পাচ্ছেন গত ১০ বছর ধরে। নিরাপত্তার জন্য পুরা মসজিদকে সিসি ক্যামেরার আওতায় রাখা হয়েছে। জনশ্রুতি রয়েছে, এই মসজিদে যদি কিছু মানত করা হয় তাহলে শুভ ফল পাওয়ায়।

আরও পড়ুনঃ ম্যাজিক প্যারাডাইস পার্ক কুমিল্লা

বজরা শাহী মসজিদের স্থাপত্যশৈলী 

অপূর্ব কারুকার্যমন্ডিত নোয়াখালীর (noakhali) বিখ্যাত বজরা শাহী মসজিদ। মসজিদটির রয়েছে অত্যান্ত সুন্দর প্রবেশ তোরণ। মসজিদের মতোই প্রবেশ তোরণ মোজাইক দিয়ে সুসজ্জিত করা আছে। প্রবেশ তোরণের ওপর কয়েকটি গম্বুজ রয়েছে। এর মধ্যে আছে একটি বড় গম্বুজ।

এই মসজিদের দৈর্ঘ্য প্রায় ১১৬ ফুট, প্রস্থ প্রায় ৭৪ ফুট এবং উচ্চতা প্রায় ২০ ফুট। মাটির প্রায় ২০ ফুট নিচে থেকে বজরা শাহী মসজিদ এর ভিত তৈরি করা হয়েছে। ৩ গম্বুজ বিশিষ্ট এই মসজিদের ভিতরে প্রবেশ করার জন্য রয়েছে ৩ টি দরজা। দরজাগুলো ধনুকাকৃতির। কেবলার দিকে রয়েছে ৩ টি কারুকার্যমন্ডিত মিহরাব। ৩ টি মিহরাবের মধ্যেরটা অন্য দুটির তুলনায় অপেক্ষাকৃত বড়।

বজরা শাহী মসজিদ এর অভ্যন্তরে বহু শিখরের খিলান দ্বারা তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এর অভ্যন্তরে আছে দুটি কক্ষ, যা বহুখাঁজবিশিষ্ট আড়াআড়ি খিলান দ্বারা তিনটি ‘বে’- তে বিভক্ত করা হয়েছে। মধ্যের ‘বে’-টি বর্গাকার এবং পার্শ্ববর্তী দুইটি ‘বে’ আয়তাকার। মসজিদ এর ছাদের ওপর আছে তিনটি কন্দাকৃতির গম্বুজ। উত্তর দক্ষিণে লম্বা মসজিদটির বাইরের চার কোনায় রয়েছে অষ্টভুজাকৃতির বুরুজ। বাইরের দিকে দরজা অভিক্ষিপ্ত এবং দরজার উভয় পাশে আছে সরু মিনার। 

মসজিদের বাহির এবং ভেতরের দেওয়ালগুলো বৈচিত্র্যপূর্ণ নানা ধরনের খোপ খিলান নকশা দ্বারা চমৎকারভাবে অলংকৃত করা হয়েছে। এর প্রধান মিহরাবটিতে আছে জাঁকালো স্টাকো অলংকরণ। বর্তমানে এর প্রতিটি অংশ বিভিন্ন রং এর চিনামাটির পাত্রের টুকরা দ্বারা অলংকৃত করা হয়েছে অতি সূক্ষ্ম ভাবে। এর স্থাপত্যশৈলী প্রকাশ করে মুঘল সাম্রাজ্যের নিদর্শন। 

কিভাবে যাবেন 

নোয়াখালীর মাইজদী শহর থেকে বজরা শাহী মসজিদ এর দুরত্ব ১৫ কিলোমিটার।  বাস বা ট্রেনের মাধ্যমে মাইজদী যেতে হবে প্রথমে। সেখান থেকে সোনাইমুড়ীগামী যেকোনো লোকাল বাস, সিএনজি বা অটোরিকশায় বজরা হাসপাতালের সামনে নেমে ২০০ গজ এগিয়ে গেলে পৌঁছে যাবেন ঐতিহাসিক এই মসজিদে। এছাড়া বজরা বাসস্ট্যান্ড হতে বাসে করে রিক্সা অথবা পায়ে হেঁটে বজরা শাহী মসজিদ কমপ্লেক্সে যেতে পারবেন। 

বাসে ঢাকা-মাইজদী

রাজধানী ঢাকার সায়দাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে একুশে এক্সপ্রেস, মুনলাইন এন্টারপ্রাইজ, হিমাচল এক্সপ্রেস বাসগুলো নোয়াখালীর মাইজদীতে যায়। এছাড়াও ধানমন্ডির জিগাতলা কাউন্টার থেকে একুশে পরিবহনের বাস নোয়াখালীর উদ্দেশ্যে রাত দশটা ২০ মিনিটে ছাড়ে। বাস ভাড়া ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত (নন-এসি এবং এসি) । 

ট্রেনে ঢাকা-মাইজদী

ঢাকা থেকে ট্রেনে করে নোয়াখালী (noakhali) জেলার মাইজদী স্টেশনে নামতে হবে। ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে বৃহস্পতিবার ব্যতীত সপ্তাহের বাকি ৬ দিন বিকেল ৪ঃ২০ মিনিটে উপকুল এক্সপ্রেস নামক আন্তঃনগর ট্রেন নোয়াখালীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। ৬ ঘন্টা সময় লাগে নোয়াখালীর মাইজদী পৌঁছাতে। শ্রেণীভেদে টিকেট ভাড়া ২৩০ থেকে ৫০৩ টাকা। 

কোথায় থাকবেন 

থাকার জন্য বেশ কিছু মাঝারি মানের আবাসিক হোটেল রয়েছে নোয়াখালীতে (noakhali)। হোটেল গুলোতে অল্প খরচে রাত্রি যাপনের পাশাপাশি প্রায় প্রতিটি আবাসিক হোটেলের নিচেই রয়েছে খাবারের হোটেল। কয়েকটি আবাসিক হোটেলের তালিকা নিতে দেওয়া হল : 

  • পুবালি হোটেল (0321-61257)
  • হোটেল আল মোরশেদ (0321-62173)
  • হোটেল রাফসান (0321-61395)
  • সার্কিট হাউস 
  • টাউন হল 
  • রয়েল হোটেল 
  • হোটেল লিটন 
  • নোয়াখালী গেস্ট হাউস 

শেষকথা 

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, “মসজিদেরই পাশে আমার কবর দিও ভাই, যেন গোরে থেকেও মুয়াজ্জিনের আজান শুনতে পাই।” মসজিদ আমাদের মুসলমানদের জন্য ইবাদতের স্থান। মুসলিম প্রধান দেশ হওয়ায় আমাদের দেশে রয়েছে অনেক মসজিদ।

অনেক মসজিদ আছে যেগুলো শত শত বছর পুরানো, ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে এখনো টিকে আছে এদেশের বুকে। তেমনি এক ঐতিহাসিক মসজিদ হল নোয়াখালীর বজরা শাহী মসজিদ। আশা করছি ওপরের আলোচনা থেকে এই মসজিদ সম্পর্কে কিছুটা হলেও ধারণা পেয়েছেন।

এই মসজিদে নামাজ পড়ার জন্য এবং এর সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য দেশ এবং দেশের বাহিরের অনেক পর্যটকের সমাগম হয় প্রতিদিন। আপনাদের বজরা শাহী মসজিদ দেখার আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। 

বজরা শাহী মসজিদ সম্পর্কিত প্রশ্ন এবং উত্তর / FAQ’s 

১. বজরা শাহী মসজিদ কোথায় অবস্থিত? 

উত্তর : নোয়াখালীর মাইজদী শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার উত্তরে সোনাইমুড়ী থানার বজরা নামক স্থানে প্রধান সড়কের পশ্চিম পাশে অবস্থিত বিখ্যাত বজরা শাহী মসজিদ।

২. কত সালে নির্মাণ করা হয় বজরা শাহী মসজিদ? 

উত্তর : ১১৫৪ হিজরী, ১১৩৯ বাংলা মোতাবেক ১৭৪১ সালে অর্থাৎ প্রায় ৩০০ বছর আগে নির্মাণ করা হয় ঐতিহাসিক বজরা শাহী মসজিদ।

৩. বজরা শাহী মসজিদের প্রথম ইমাম কে ছিলেন? 

উত্তর : মুঘল সম্রাট মোহাম্মদ শাহ এর অনুরোধে সৌদি আরবের পবিত্র কাবা শরীফ হতে মাওলানা শাহ আবু সিদ্দীক বজরা শাহী মসজিদের প্রথম ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেছিলেন।

৪. বজরা শাহী মসজিদের বর্তমান ইমাম কে? 

উত্তর : বর্তমানে বজরা শাহী মসজিদ এর ইমাম হিসেবে নিযুক্ত আছেন শাহ আবু সিদ্দিক সাহেবের সপ্তম পুরুষ ইমাম হাসান সিদ্দীকি। 

৫. বজরা শাহী মসজিদের গম্বুজ সংখ্যা কয়টি?  

উত্তর : বজরা শাহী মসজিদের গম্বুজ সংখ্যা ৩ টি। গম্বুজগুলো অষ্টকোণাকার এবং এগুলো মার্বেল পাথর দিয়ে তৈরি করা। 

আরও পড়ুন-

সীতাকুণ্ড দর্শনীয় স্থান

কাপ্তাই লেক, রাঙ্গামাটি

মন্তব্য করুন