বাঁশখালী সমুদ্র সৈকত
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশের অন্যতম আকর্ষণ এই দেশের দক্ষিণে অবস্থিত বঙ্গোপসাগর এবং এই সাগরস্থ সমুদ্র সৈকত। তেমনই একটি মনোরম সুন্দর সমুদ্র সৈকত হচ্ছে বাঁশখালী সমুদ্র সৈকত, যা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগে অবস্থিত।
এটি বাঁশখালী উপজেলার একটি বিখ্যাত সমুদ্র সৈকত, যার অন্য নাম বাহারছড়া সমুদ্র সৈকত। এই সমুদ্র সৈকতটি চতুর্দিকে বালুচর দ্বারা বেষ্টিত । এই সৈকতটি প্রধান দুইটি পয়েন্টে বিভক্ত। একটির নাম কদমরসুল পয়েন্ট আর অন্য পয়েন্টটি খানখানাবাদ পয়েন্ট নামে বহুল পরিচিত।
সমুদ্র সৈকতটির দৈর্ঘ্য প্রায় ২৩ মেইল বা ৩৭ কিলোমিটার। বিশ্বের বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের পর এটি বাংলাদেশে অবস্থিত বিশ্বের দ্বিতীয় দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত।
আরও পড়ুনঃ হিমছড়ি ঝর্ণা
অবস্থান
বাঁশখালী সমুদ্র সৈকত চট্টগ্রাম শহরের ৪০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। এটি চট্টগ্রামের সর্বদক্ষিণের বাঁশখালী উপজেলাস্থ ছনুয়া, সরল, গন্ডামারা,খানখানাবাদ, বাহারছড়ার উপকূলবর্তী এলাকা জুড়ে অবস্থিত। এই সৈকতের পুরো পশ্চিম দিক জুড়ে রয়েছে কুতুবদিয়া চ্যানেল।
কুতুবদিয়া দ্বীপও এই সমুদ্র সৈকতের কাছে অবস্থিত। এই সমুদ্র সৈকতের উত্তরে রয়েছে শঙ্খনদী, দক্ষিণে আছে চকরিয়া এবং পেকুয়া। এছাড়া পূর্বদিকে পাহাড়ী এলাকা এবং এর পশ্চিম সীমান্ত অবস্থিত বঙ্গোপসাগরের সীমারেখায়।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য
ঝাউবন ও প্যারাবন
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে ২০০৭ সালে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় সিডর সংঘটিত হওয়ার পর বাঁশখালী সমুদ্র সৈকতে রোপন করা হয় অসংখ্য ঝাউ গাছ। সেখানে এখন গড়ে উঠেছে মনোমুগ্ধকর ঝাউ বাগান।
লাল কাঁকড়া
বাঁশখালী সমুদ্র সৈকতে লাল কাঁকড়ার দেখা পাওয়া যায়। বেশিরভাগ দিন সকালে লাল কাঁকড়াগুলোর দ্রুত চলা পর্যটকদের আনন্দ দেয়।
সূর্যাস্ত
সৈকতের আরেকটি বিশেষ আকর্ষণ হচ্ছে সূর্যাস্ত। এই সমুদ্র সৈকত থেকে দারুণভাবে সূর্যাস্তের সৌন্দর্য উপভোগ করা সম্ভব। আর শহরের কোলাহল থেকে দূরে অবস্থান হওয়ায় এই সৈকতে পর্যটকের ভীড় সাধারণত কিছুটা কম দেখা যায়।
ইকোপার্ক
বাঁশখালী সমুদ্র সৈকতে রয়েছে একটি ইকোপার্ক ও নয়নাভিরাম চা বাগান।
পুরাকীর্তি
বাঁশখালী সমুদ্র সৈকতের পাশেই আছে বহুল পরিচিত পুরাকীর্তি। প্রায় পাঁচশো বছর বয়সী প্রাচীন বকশি হামিদ মসজিদের অবস্থান এই সমুদ্র সৈকতের কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে অবস্থিত।
এককথায়, সমুদ্র সৈকতের বিশাল উপকূল বিনোদন প্রেমী যে কাউকে আকৃষ্ট করবে খুব সহজেই। এখানে পর্যটকরা একসাথে অনেক জায়গা দেখার সুযোগ পেয়ে থাকেন বেশ অনায়াসে।
মনোরম সৌন্দর্য
সাগরের ঢেউ, পাহাড়ের প্রাচীরের পাশাপাশি এই সমুদ্র সৈকতের প্যারাবন ও ঝাউবনের সৌন্দর্য যে কাউকে মুগ্ধ হতে বাধ্য করে। নদী, পাহাড় আর সাগরের আকর্ষণীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত একটি সম্ভাবনাময় স্থান এই সমুদ্র সৈকত। এখানে সমুদ্রের পানি একদম লেকের পানির মতো পরিষ্কার। ঢেউয়ের সাথে আসে স্বচ্ছ জলরাশি।
ভ্রমণের সময়
বাঁশখালী সমুদ্র সৈকতটি ক্রমশ পর্যটকদের নিকট আরো আকর্ষণের জায়গায় পরিণত হয়ে চলেছে। প্রতিদিন সকাল এবং বিকাল এই সমুদ্র সৈকতটি অসংখ্য পর্যটকের আনাগোনায় মুখরিত হয়ে থাকে। সাধারণত শীতের শুরুতে এবং শেষে এই সমুদ্র সৈকতে বেশি মানুষের উপস্থিতি দেখা যায়।
তবে সম্প্রতি অক্টোবর এবং নভেম্বর মাসে শীত মৌসুমের শুরুতে পর্যটকদের আনাগোনা অনেকটা চোখে পড়ার মতো ছিল।
পর্যটন কেন্দ্র স্থাপন
সমুদ্রের উপকূলে অবস্থিত মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের উৎস এই বাঁশখালী সমুদ্র সৈকত। সম্প্রতি এই এলাকায় একটি পর্যটন কেন্দ্র স্থাপনের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় এলাকাবাসীসহ এলাকার বিভিন্ন সংগঠন ও তদসংশ্লিষ্ট মহল। এই দাবিতে তারা জাতীয় বনবিভাগ ও সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা কামনা এবং আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
অন্যান্য সমুদ্র সৈকত
কক্সবাজার, কুয়াকাটা, পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতের চেয়ে বাঁশখালী সমুদ্র সৈকত অধিক প্রশস্ত। বর্ষার সময় এই প্রশস্ততা সামান্য কমে যায়। বিগত ১৯৯১ সালের পর থেকে কয়েকটি ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় এই সৈকতের নিকটবর্তী কিছু বেঁড়িবাধ ভেঙে তছনছ করে দিয়েছে।
এর ফলে এই সৈকতের পর্যটন সৌন্দর্য পরিপূর্ণভাবে সেখানে বিকশিত হতে পারছে না। বর্তমান বাংলাদেশ সরকার পূর্বের বেঁড়িবাধসমূহ পুনরায় নির্মাণ বা মেরামতের মাধ্যমে এই সৌন্দর্যময় সৈকতের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দৃশ্যমান করার চেষ্টা করে চলেছে।
যাওয়ার উপায়
বাঁশখালী সমুদ্র সৈকতে ঘুরতে যেতে চাইলে প্রথমেই বাংলাদেশের যেকোন জায়গা থেকে আসতে হবে সরাসরি চট্টগ্রাম শহরে। এরপর নতুন ব্রিজ অথবা বহাদ্দারহাট নামের বাস টার্মিনাল থেকে পাওয়া যায় সিএনজি বা বাস, যেটা পৌঁছে দেবে গুনাগরি বাজার পর্যন্ত।
সেখানে নেমে সিএনজিতে করে চলে যাওয়া যাবে বাঁশখালী সৈকত। এছাড়া ব্যক্তিগত পরিবহন বা ভাড়া করা গাড়িতে সরাসরি চট্টগ্রাম থেকে বাঁশখালী উপজেলার গুণাগরি বাজার পার হয়ে সরাসরি এই সৈকতে খুব সহজেই যাওয়া যায়।
থাকার ব্যবস্থা
চট্টগ্রাম শহর থেকে একদিনেই গিয়ে ঘুরে আসা বা সকালে গিয়ে বিকেল বা সন্ধ্যার মধ্যে অনায়াসেই ফিরে আসা যায় বাঁশখালী সমুদ্র সৈকত থেকে। থাকার জন্য চট্টগ্রাম শহরের ষ্টেশন রোড, আগ্রাবাদ, জিইসি মোড় বা নিকটবর্তী এলাকায় পাওয়া যায় বিভিন্ন ধরণের হোটেল।
সেবা ও অবস্থানভেদে এই হোটেলগুলোর ভাড়া দিনপ্রতি ১০০০ থেকে ১০০০০ টাকার মধ্যে। আবাসিক হোটেলের মধ্য ডায়মন্ড পার্ক, স্টার পার্ক, হিল টন সিটি,মিসখা, এশিয়ান, প্যারামাউন্ট, এসআর, সিলমন ও সাফিনা উল্লেখযোগ্য।
খাবার ব্যবস্থা
বাঁশখালীতে কিছু সাধারন তবে ভালো মানের হোটেল আছে। এছাড়া মনছুড়িয়া বাজারেও কিছু চায়ের দোকান বা নাস্তা করার মতো জায়গা আছে। চট্টগ্রাম এলাকায় বা শহরে বাঙ্গালি, ইতালিয়ান, চাইনিজ খাবার বা ফাস্ট ফুডের জন্য ভাল মানের ফাস্টফুড শপ, ক্যাফে আছে।
এছাড়া চট্টগ্রামের বহুল আলোচিত, জনপ্রিয় ও বিখ্যাত মেজবানি খাবার সকলের চাহিদার শীর্ষে থাকে সবসময়। সাথে আছে সকলের প্রশংসিত কালা ভুনা এবং বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছের প্রণালি। পরিমাণ এবং পরিবেশভেদে এসব খাবার পাবেন জনপ্রতি ১০০ থেকে ১০০০ টাকার মধ্যে।
বাঁশখালী সমুদ্র সৈকত ভ্রমনে সতর্কতা
*বাঁশখালী সমুদ্র সৈকতে বেশি দোকান নেই, তাই দীর্ঘ সময় কাটানোর পরিকল্পনা বা সাথে বাচ্চা থাকলে শুকনো খাবার এবং যথেষ্ট পানি সাথে রাখা উত্তম।
*সমুদ্রের পানিতে নামার আগে জোয়ার-ভাটার সময় জেনে নামা উচিত।
*নিজের গুরুত্বপূর্ণ জিনিস অবশ্যই নিজ দায়িত্বে, নিরাপদ স্থানে রাখা উচিত।
*ফেরার ক্ষেত্রে অনেক সময় যানবাহন পাওয়া কষ্টকর হয়ে যায়। প্রয়োজনে সিএনজি বা অটো রিজার্ভ করে বা ভাড়ার সময় নির্ধারণ করে নেওয়া যেতে পারে।”
পরিশেষে
পরিশেষে বলা যায়, বাঁশখালী সমুদ্র সৈকত ভ্রমণে যাওয়ার আগে সঠিক তথ্য নিয়ে যাওয়া উচিত। প্রত্যেকের সমুদ্র সৈকতে একবার ভ্রমনে যাওয়া উচিত। এতে কাজের প্রতি এক ঘেয়েমি কমে যায়। তাই পরিবার নিয়ে ঘুরে আসতে পারেন বাঁশখালী সমুদ্র সৈকত। আশা করি ভাল লাগবে।
বাঁশখালী সমুদ্র সৈকত সম্পর্কিত কিছু সাধারণ প্রশ্ন (FAQ)
১. বাঁশখালী সমুদ্র সৈকত কি?
উত্তর: বাঁশখালী সমুদ্র সৈকত বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলাইয় অবস্থিত একটি প্রাকৃতিক সমুদ্র সৈকত, যেটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য সুপ্রসিদ্ধ।
২. বাঁশখালী সৈকতে যাওয়ার জন্য সেরা সময় কী?
উত্তর: বাঁশখালী সমুদ্র সৈকত ভ্রমণের জন্য সেরা সময় নভেম্বর থেকে এপ্রিল মাস।
৩. সমুদ্র সৈকত ভ্রমণের জন্য কিভাবে পৌঁছানো যায়?
উত্তর: বাঁশখালী সমুদ্র সৈকতে যাওয়ার জন্য চট্টগ্রাম পর্যন্ত প্লেন, ট্রেন অথবা বাসে যেতে পারেন। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম থেকে বাঁশখালী উপজেলার গুণাগরি বাজার পার হয়ে সরাসরি এই সৈকতে খুব সহজেই যাওয়া সম্ভব।
৪. সমুদ্র সৈকতে কি-কি দেখতে পারি?
উত্তর: সমুদ্র সৈকতে সমুদ্রের দৃশ্য, ঝাউবন, প্যারাবন, ইকোপার্ক ইত্যাদি দেখে যেকোনো পর্যটক মুগ্ধ হতে পারেন।
আরও পড়ুন-
দ্যা প্যালেস লাক্সারি রিসোর্ট ও ভ্রমণ গাইড
শ্রীমঙ্গল রিসোর্ট সম্পর্কিত তথ্য ও ভ্রমণ গাইড