আহসান মঞ্জিল
পুরান ঢাকার ইসলামপুরে কুমারটুলী এলাকায় বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত আহসান মঞ্জিল (ahsan manzil) এর সাথে জড়িয়ে রয়েছে ঢাকার শত বছরের পুরনো ইতিহাস। ঢাকার প্রাচীন স্থাপনা গুলোর মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্থাপত্য হিসেবে বিবেচনা করা হয় এই আহসান মঞ্জিলকে। নবাব পরিবারের বহুৎ স্মৃতি বিচলিত এই প্রাসাদটি বর্তমানে জাদুঘর হিসেবে পরিচালিত হচ্ছে।
ঢাকার ইতিহাসের অন্যতম একটি স্থাপত্য আহসান মঞ্জিল। আহসান মঞ্জিল (ahsan manzil) বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে কুমারটুলি এলাকায় ঢাকার নবাবদের আবাসিক প্রাসাদ ও জমিদারদের সদর কাচারি, বর্তমানে জাদুঘর। কথিত আছে, মুঘল আমলে এখানে জামালপুর পরগনার জমিদার শেখ এনায়েতুল্লাহর রংমহল ছিল।
পরে তার পুত্র মতিউল্লার নিকট থেকে রংমহলটি ফরাসিরা ক্রয় করে এখানে একটি বাণিজ্য কুঠি স্থাপন করে। ১৮৩০ সালে খাজা আলিমুল্লাহ ফরাসিদের নিকট থেকে কুঠি বাড়িটি কিনে নেন এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধন করে এটি নিজের বাসভবনে পরিণত করেন।
আরও পড়ুনঃ সীতাকুণ্ড দর্শনীয় স্থান
আহসান মঞ্জিলের ইতিহাস
এই বাসভবন কে কেন্দ্র করে খাজা আব্দুল গনি মার্টিন এন্ড কোম্পানি নামক একটি ইউরোপীয় নির্মাণ ও প্রকৌশলী প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে একটি মাস্টার প্ল্যান তৈরি করেন যার প্রধান ইমারত ছিল(ahsan manzil) আহসান মঞ্জিল। ১৮৫৯ সালে আহসান মঞ্জিল এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে। ১৮৭২ সালের সমাপ্ত হয়।
আব্দুল গনি তার পুত্র খাজা আহসানুল্লাহর নাম অনুসারে ভবনের নামকরণ করেন আহসান মঞ্জিল। ওই যুগে নবনির্মিত প্রাসাদ ভবনটি রংমহল এবং পূর্বেকার ভবনটি অন্দরমহল নামে পরিচিত ছিল। ১৮৮৮ সালে ৭ এপ্রিলে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে আহসান মঞ্জিল এর ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়, বিশেষ করে অন্দরমহল টি একেবারে ভেঙে পড়ে। নবাব আহসানুল্লাহ অন্দরমহলটি পুনঃনির্মাণ ও রংমহলটি মেরামত করেন।
এই মেরামত কাজের জন্য রানীগঞ্জ থেকে উন্নত মানের ইট আনা হয়। মেরামত কর্ম পরিচালনা করেন প্রকৌশলী গোবিন্দ চন্দ্র রায়। রংমহলটির উপর বর্তমানে যে সুদৃশ্য গম্বুজ রয়েছে তা এ সময়ে সংযোজন করা হয়। ১৮৯৭ সালের ১২ জুনের ভূমিকম্পে আবার আহসান মঞ্জিল প্রভূত ক্ষতি সাধন হয়। তবে পরে নবাব আহসানুল্লাহ তার সংস্কার করিয়ে নিয়েছিলেন।
আহসান মঞ্জিল পরিদর্শনের নির্ধারিত সময়সীমা
শনিবার থেকে বুধবার সকাল ১০ঃ৩০ থেকে বিকাল ৫ঃ৩০ পর্যন্ত আহসান মঞ্জিল দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে। আর প্রতি শুক্রবার বিকেল ৩ টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত আহসান মঞ্জিল পরিদর্শন করা যায়। শুক্রবাব সহ ও অন্যান্য ছুটির দিনে আহসান মঞ্জিল বন্ধ থাকে।
আহসান মঞ্জিলের বিবরণ
আহসান মঞ্জিল(ahsan manzil) দেশের একটি উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য নিদর্শন। ১ মিটার উঁচু বেদির উপর স্থাপিত দ্বিতল প্রাসাদ ভবনটির আয়তন ১২৫.৪ মি x ২৮.৭৫ মি। নিচ তলায় মেজে থেকে ছাদ পর্যন্ত উচ্চতায় ৫ মিটার এবং দোতালায় ৫.৮ মিটার। প্রাসাদটির উত্তর ও দক্ষিণ উভই দিকে একতলার সমান উঁচু করে গাড়ি বারান্দা। দক্ষিণ দিকের গাড়ি বারান্দার উপর দিয়ে দোতলার বারান্দা থেকে একটি সুবৃহৎ খোলা সিঁড়ি সম্মুখস্থ বাগান দিয়ে নদীর ধার পর্যন্ত নেমে গেছে।
প্রাসাদের উভয় তলার উত্তর ও দক্ষিণ দিকের রয়েছে। অর্ধ বৃত্তাকার খিলান সংযোগে প্রশস্ত বারান্দা। দোতলায় নির্মিত অনুরূপ গোলাকার কক্ষের ঊর্ধাংশে স্কুইঞ্জ- এর মাধ্যমে ছাদের কাছে কক্ষটিকে অষ্টভুজাকৃতি করা হয়েছে। এই অষ্টকোন কক্ষটি ছাদের উপর গম্বুজের পিপায় পরিণত হয়েছে।
পরিশেষে, অষ্টবাহুর সূচ্যগ্র মাথাগুলিকে কেন্দ্রের দিকে ক্রমশ হেলিয়ে চূড়াতে নিয়ে কুমুদ কলির আকারে গম্বুজটি তৈরি করা হয়েছে। ভূমি থেকে গম্বুজ শিষ্যের উচ্চতা ২৭.১৩ মিটার। দোতালায় পূর্ব দিকে রয়েছে বৃহৎ আকার ড্রয়িং রুম। এর উত্তরে লাইব্রেরির ও কার্ডরুম এবং পূর্ব প্রান্তে চারটি বর্গাকার কক্ষ।
দোতালায় পশ্চিম দিকে আছে বৃহৎ আকার জলসা ঘর এবং উত্তরে হিন্দুস্তানি কক্ষ এবং পশ্চিম প্রান্তে চারটি বর্গাকার কক্ষ। এই কক্ষ দুটির মেজের উপরে আবরণ কাঠের পাঠাতনের তৈরি। নিচতলায় পূর্বাংশে রয়েছে বৃহৎ আকার ডাইনিং হল ও ছয়টি বর্গাকার কক্ষ। পশ্চিমাংশে রয়েছে বৃহৎ দরবার হল।
এর উত্তরে বিলিয়ার্ড কক্ষ। ডাইনিং ও দরবার হল এর মেজে সাদা, সবুজ, হলুদ, প্রভৃতির রঙের চিনা টালি দ্বারা অলংকৃত। নিচতলার পশ্চিম প্রান্তে নিমৃত ৫ টি কক্ষের মধ্যবর্তী টিতে বিখ্যাত স্ট্রং রুম। গম্বুজ কক্ষের উত্তর পাশের কক্ষটিতে রয়েছে আকর্ষণীয় কাঠের সিঁড়ি।
প্রাসাদ কক্ষের দেয়াল গুলি প্রায় ০.৭৮ মিটার পুরু। অর্ধবৃত্তাকার খিলান এর মাধ্যমে দরজাগুলো স্থাপিত। দ্বিতল অন্দরমহল টির উচ্চতার রংমহলের চেয়ে সামান্য কম। এই ভবনের ছাদ নির্মানে লোহার করি-বরগা ব্যবহৃত হয়েছে। আহসান মঞ্জিল এমন একটি স্থাপত্য যার সঙ্গে বাংলার ইতিহাসের বেশ কিছু অধ্যায় জড়িত।
আহসান মঞ্জিল পরিদর্শনে কেন যাবেন
আহসান মঞ্জিল(ahsan manzil) ভ্রমণের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ জাদুঘরের সংগ্রহশালা। মোট ৪ হাজার ৭৭ টি নিদর্শন আহসান মঞ্জিলের ৩০টি কক্ষে প্রদর্শনী জন্য উন্মুক্ত করা আছে। ৯ কক্ষ সেই নবাবি আমলের মত করে সাজানো রয়েছে। প্রতিটি কক্ষ আপনাকে সেই নবাবী আমলের ইতিহাস এর কাছে নিয়ে যাবে।
জাদুঘরে প্রদর্শনীর জন্য আছে আহসান মঞ্জিল এর ইতিহাস, নবাবদের পরিচিতি ও বংশ তালিকা। নবাবদের ব্যবহৃত বড় বড় আয়না,বড় বড় লোহার সিন্দুক ও কাঠের আলমারি ডাইনিং রুম, ড্রয়িং রুম, কাচ ও চিনামাটির থালা-বাসন, হাতির মাথার কঙ্কাল, ঢাল ও তরবারি।
নবাব আমলে তৈরিকৃত বিভিন্ন ধরনের অলংকৃত রুপা, ক্রিস্টালের তৈরি চেয়ার টেবিল, সিংহাসন, বিভিন্ন ধরনের দোল চিত্র, ফুলদানি, হিন্দুস্তানি রুম, রাজকীয় অতিথিদের বেডরুম, ও নাচঘর। আরো আছে সম সময়কালীন বিখ্যাত ব্যক্তিদের প্রতিকৃতি ও নবাবদের বিভিন্ন সমাজসেবা মূলক কাজের নিদর্শন।
কিভাবে যাবেন আহসান মঞ্জিলে
ঢাকায় সদরঘাট গামী যে কোন বাসে উঠে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে নেমে যেতে হবে। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে বা ৩০ টাকা রিক্সা ভাড়ায় আহসান মঞ্জিল(ahsan manzil) যেতে পারবেন। অথবা, ঢাকার যে কোন জায়গা থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত এসে রিক্সা অথবা সিএনজি নিয়ে সদরঘাট হয়ে আহসান মঞ্জিল দেখতে যেতে পারেন।
আবার গুলিস্তানের নর্থসাউথ রোড ধরে নয়াবাজার মোড় হয়ে বাবুবাজার ব্রিজের আগে নেমে রিকশায় আহসান মঞ্জিল যাওয়া যাবে। এছাড়াও, ঢাকার যে কোন জায়গা থেকে সরাসরি সিএনজিতে করে চলে আসতে পারবেন আহসান মঞ্জিল এ।
আরও পড়ুনঃ পলওয়েল পার্ক, রাঙ্গামাটি
আহসান মঞ্জিলের প্রবেশমূল্য
আহসান মঞ্জিলের প্রবেশ টিকিটের মূল্য ২০ টাকা ১২ বছরের নিচে শিশুদের প্রবেশ মূল্য ১০ টাকা। সার্কভুক্ত দেশের নাগরিকদের জন্য ৩০০ টাকা এবং অন্যান্য দেশের নাগরিকদের জন্য ৫০০ টাকা। অনলাইনে আহসান মঞ্জিল(ahsan manzil) এ প্রবেশের টিকিট পাবেন www. Ahsanmanzilticket.gov.bd এই ওয়েবসাইট থেকে।
ওয়েবসাইটে রেজিস্ট্রেশন করে কবে যাবেন কত জন যাবেন তা এন্ট্রি করে মোবাইল ব্যাংকিং বা ব্যাংক আইডির মাধ্যমে পেমেন্ট করতে পারবেন। পেমেন্ট সম্পন্ন হওয়ার পর একটা ই-টিকিট পাবেন তা ডাউনলোড বা প্রিন্ট করে সাথে নিতে হবে।
কোথায় খাবেন
আর খাবারের জন্য পুরান ঢাকার বিখ্যাত খাবার হোটেলগুলো তো আছেই। পুরান ঢাকার পরিবেশে যে প্রাচীনতার ছোঁয়া তার সাথে বুড়িগঙ্গা নদীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সংমিশ্রণে আহসান মঞ্জিল পরিদর্শনে অন্যরকম এক ভ্রমণ অভিজ্ঞতায় প্রফুল্ল হবে আপনার মন। নবাবী ঐতিহ্যের পরশে কিছুক্ষণের জন্য হলেও আপনি হারিয়ে যাবেন ইতিহাসে স্বর্ণযুগের খন গুলোতে।
আহসান মঞ্জিরে আগত বিদেশি অতিথি
উনিশ শতকের শেষবাগ থেকে পাকিস্তানের প্রথম পর্ব পর্যন্ত প্রায় ১০০ বছর ধরে এই ভবন থেকে পূর্ব বাংলার মুসলমানদের নেতৃত্ব দেওয়া হয়েছে। পঞ্চায়েত প্রধান হিসেবে ঢাকার নবাবগণ প্রায় প্রতিদিন এখানে সালিশি দরবার বসাতেন। মুসলিম শাসনতন্ত্রের বিশ্বাসী নবাব আহসান উল্লাহর উদ্যোগে এখানে কংগ্রেসি বিরোধী বহু সভা হয়েছে।
ব্রিটিশ ভারতের যেসব ভাইসরয়, গভর্নর ও লে, গভর্নর ঢাকা এসেছেন, তাদের সবাই এখানে আগমন করেছেন। ১৮৭৪ সালের নবাব আব্দুল গনির দানে ঢাকায় জল কলের ভিত্তি স্থাপনের জন্য বড়লাট নর্থব্রুক ঢাকা এসে এই প্রাসাদের সান্ধ্য অনুষ্ঠানে যোগ দেন।
১৮৮৮ সালের লর্ড ডাফরিন ঢাকায় এসে আহসান মঞ্জিলের(ahsan manzil) আতিথ্য গ্রহণ করে। বঙ্গ বিভাগ পরিকল্পনার প্রতি জনসমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে ১৯০৪ সালের লর্ড কার্জন পূর্ববঙ্গ সফরে এসে ১৮ থেকে ১৯ ফেব্রুয়ারি এই প্রাসাদে অবস্থান করে। খাজা সলিমুল্লাহ তার যাবতীয় রাজনৈতিক কর্মকান্ড এই প্রাসাদ থেকে পরিচালনা করেছেন। নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সূতিকাগার হিসেবে আহসান মঞ্জিল আজ ইতিহাসের অঙ্গ।
ঢাকার নবাবদের প্রভাব প্রতিপত্তি হ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে আহসান মঞ্জিলের জৌলুস ও স্তিমিত হতে থাকে। জমিদারি উচ্ছেদ আইনের আওতায় ১৯৫২ সালের ঢাকা নবাব স্টেট অধিগ্রহণ করা হলে অর্থাভাবে নবাবদের উত্তরাধিকারের পক্ষে এ প্রাসাদ রক্ষণাবেক্ষণ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
জমিদারি অধিগ্রহণের পরপরই খাজা হাবিবুল্লাহ এই প্রাসাদ ছেড়ে পরিবাগ গ্রীন হাউসে বসবাস শুরু করেন। অংশীদারগণ বাছ বিচার না করে প্রাসাদের কক্ষ সময় ভাড়া দেওয়ায় ভবনটির ধ্বংসের দিকে যেতে থাকে। কাল ক্রমে অবৈধ দখলদারীরা স্থানটিকে নোংরা বস্তিতে পরিণত করে।
আহসান মঞ্জিল এর ঐতিহাসিক ও স্থাপতিক্য গুরুত্বপূর্ণ অনুধাবন করে বাংলাদেশ সরকার ভবনটিকে সংস্কার করে জাদুঘরে পরিণত করার উদ্যোগ নেয়। ১৯৮৫ সালে আহসান মঞ্জিল ও সংলগ্ন চত্বর অধিগ্রহণ করা হয়। গণপূর্ত ও স্থাপত্য অধিদপ্তরের দায়িত্বে এর সংস্কার কাজ সমাপ্ত হয় ১৯৯২ সালে। ওই বছর ২০ সেপ্টেম্বর থেকে প্রাসদ টি বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের নিয়ন্ত্রণে আনা হয় এবং এখানে একটি জাদুঘর স্থাপন করা হয়।
শেষ কথা
সর্বোপরি, ঢাকায় দর্শনীয় স্থানে ভ্রমণের ইচ্ছে থাকলে আপনি নির্দ্বিধায় আহসান মঞ্জিল(ahsan manzil) ও ভ্রমণ করতে পারেন। সুন্দর মনোরম এই পুরাতত্ত্বিক নিদর্শন আপনাকে ইতিহাসের এক নিদারুণ সৌন্দর্য উপভোগ করাবে। আশা করি, আপনি আহসান মঞ্জিল বিষয় নিয়ম সম্পর্কে জানতে পেরেছেন।
আপনি যদি এই সম্পর্কের না জেনে থাকেন তাহলে অবশ্যই ভাল হবে জেনে নিন। আপনার সুস্থতা কামনা করে আজকের মত এখানেই শেষ করছি “ধন্যবাদ।
আরও পড়ুন-
বজরা শাহী মসজিদ নোয়াখালী
নিঝুম দ্বীপ নোয়াখালী