লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, পরিচিতি ও ভ্রমণ গাইড

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান

যারা বনাঞ্চলে ঘুরতে ভালোবাসেন তারা শ্রীমঙ্গলের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান থেকে ঘুরে আসতে পারেন। এটি একটি ১২৫০ হেক্টর আয়তনের বন। বিশাল বড় বন হওয়ায় এটিকে বেশ কয়েকটি বিভাগে ভাগ করা হয়েছে।

আপনি চাইলে একই ট্যুরে বনের সবগুলো ক্যাটাগরি থেকেই ঘুরে আসতে পারেন। বলে রাখা ভালো এই বনটি সৃষ্টিতে কাজ করেছে বাংলাদেশ বন বিভাগ কর্তৃপক্ষ। বর্তমানে বাংলাদেশ বন বিভাগ বোর্ডই এই বনের তদারকি করছে৷

যাইহোক! উদ্যান ভ্রমণ গাইডলাইন এবং লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ভ্রমণ খরচ সম্পর্কে জানতে আমাদের সাথেই থাকুন। 


আরও পড়ুনঃ ভোলাগঞ্জ সাদা পাথর


লাউয়াছড়া উদ্যান পরিচিতি

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান

শুরুতে জানবো লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান পরিচিতি সম্পর্কে। এটি শ্রীমঙ্গলের বেশ জনপ্রিয় একটি পর্যটন কেন্দ্র। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো একটি বর্তমানে বাংলাদেশের জাতীয় বন হিসাবে স্বীকৃতি একটি বন পরিচয়ে পরিচিত। 

বিভিন্ন প্রজাতির জীবজন্তু থেকে শুরু করে গাছপালাসহ প্রকৃতির সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন উপকরণে ভরপুর এই বন। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো উদ্যানটি সবসময়ই গাছপালাতে অনেক বেশি ভরে থাকে। ফলে মাঝেমধ্যে এখানে সূর্যের আলো প্রবেশের কোনো সুযোগই থাকে না। 

তাছাড়া এখানে অনেক বেশ বৃষ্টি হয়ে থাকে। এই জন্যই বোধহয় লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানকে অতিবৃষ্টির বন বলা হয়ে থাকে। 

আর যদি ইতিহাসের ব্যাপারে জানতে চান সেক্ষেত্রে বলবো ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে তদানিন্তন ব্রিটিশ সরকারের হাত ধরে এই বনটির সৃষ্টি হয়েছে। ব্রিটিশ সরকারই সর্বপ্রথম এখানে বিভিন্ন গাছপালার চারা রোপন করে বনায়নের যাত্রা শুরু করে। 

লাউয়াছড়া ভ্রমণে কি কি দেখবেন

গাছপালার পাশাপাশি উদ্যানের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো এর জীববৈচিত্র্য। এখানে আপনি একই বিভিন্ন ক্যাটাগরির প্রাণী দেখতে পাবেন। মোটকথা দুর্লভ উদ্ভিদ এবং প্রাণীর বদৌলতেই মূলত এই উদ্যানটিকে জাতীয় উদ্যানে ভুষিত করা হয়েছে৷ 

লাউয়াছড়া ভ্রমণে আপনি একই সাথে ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৪ প্রজাতির উভচর, ৬ প্রজাতির সরীসৃপ, ২৪৬ প্রজাতির পাখিসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা দেখতে পাবেন। 

এখানকার গাছপালার সংখ্যা নেহায়েত কম নয় বলে পৃথিবীতে যে কত ধরণের গাছপালা পাওয়া যায় তা বুঝতে একদিন সময় করে এই লাউয়াছড়া উদ্যান ঘুরে যেতে পারেন। আর এই ভ্রমণ আপনাকে একইসাথে পৃথিবীর ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ দেখার সুযোগ করে দেবে। 

যাইহোক! যদি এই উদ্যানের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রাণী সম্পর্কে জানতে চান সেক্ষেত্রে বলবো বিলুপ্তপ্রায় উল্লুকের কথা। বর্তমান তথ্য অনুযায়ী লাউয়াছড়ার বনে এখনো পর্যন্ত মাত্র ৪৯ টি উল্লুক রয়েছে। 

সারা বাংলাদেশ থেকে উল্লুক প্রায় বিলুপ্তি পথে হলেও লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে আপনি এখনো উল্লুকের দেখা পাবেন। এছাড়াও উচ্চতায় ২০‌-২২ ইঞ্চির মায়া হরিণসহ বন্য পাখির মধ্যে ঘুঘু থেকে শুরু করে টিয়া পর্যন্ত বিভিন্ন ধরণের পাখি উপভোগের সুযোগ পাবেন। 

অবস্থান

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের অবস্থান হলো শ্রীমঙ্গলে। তবে মজার ব্যাপার হলো এই আয়তনে এই লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানটি বিশাল। এখানে আপনি ৩ টির মতো ট্রেইল পাবেন। 

দেড়, এক এবং তিন ঘন্টার এসব ট্রেইলে পৌঁছাতেই আপনার অনেক সময় লেগে যাবে। মোটকথা উদ্যানের অবস্থান কাছাকাছি হলেও এখানে ভালোভাবে ঘুরাঘুরি করতে করতেই অনেকটা সময় লেগে যেতে পারে।

কিভাবে যাবেন

বাংলাদেশের যেকোনো অঞ্চল থেকে আপনি চাইলে ট্রেনে কিংবা বাসে করে কমলগঞ্জ অথবা শ্রীমঙ্গলে পৌঁছে যেতে পারেন৷ এক্ষেত্রে ট্রেন হিসেবে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে পারাবত এক্সপ্রেসের সাহায্য নিতে পারেন। 

এটি মূলত একটি আন্তঃনগর ট্রেন এবং সপ্তাহের ৬ দিনই এটি ৬.৪০ মিনিটে তার যাত্রা শুরু করে। এছাড়াও জয়ন্তিকা এক্সপ্রেসও শ্রীমঙ্গলমুখী ট্রেন হিসাবে সার্ভিস দিয়ে থাকে। আশা করি উদ্যানটিতে ট্রেনে করে যেতে পারলে তা ১১৫ থেকে ৭৬৫ টাকাতেই হয়ে যাবে। 

অর্থ্যাৎ সিলেটগামী যেকোনো বাস বা ট্রেনে করে আপনাকে শুরুতে শ্রীমঙ্গল এসে পৌঁছাতে হবে। এরপর শ্রীমঙ্গল থেকে সিএনজি করে সোজা লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। 

আর যারা সিএনজি ছাড়া বাসে করেই উদ্যানটিতে যেতে চান তারা স্টেশন থেকে রিকশা করে ভানুগাছা এবং ভানুগাছা থেকে বাসে করে সোজা লাউয়াছড়া উদ্যানে চলে যেতে পারেন। এক্ষেত্রে ভাড়া হিসাবে মাত্র ১০/- হলেই চলবে।

ভ্রমণে কোথায় থাকবেন

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান কতৃপক্ষের নিজস্ব একটি ফরেস্ট রেস্ট হাউজ রয়েছে। আপনি চাইলে রাত কাটানোর জন্য এই রেস্ট হাউজটির সাহায্য নিতে পারেন৷ আর এখানে থাকতে হলে পারমিশন নিতে বন কতৃপক্ষের সাথে কথা বলে নিতে পারেন। আশা করি তাদের কোনো আপত্তি থাকবে না। 

আর যদি নিজের মতো করে থাকতে চান সেক্ষেত্রে ভানুগাছার মেইন সড়কের টি রিসোর্টে উঠে পড়তে পারেন। এই টি রিসোর্টটি সার্ভিসের দিক দিয়ে বেশ মানসম্মত। এছাড়াও ফাইভ স্টার হোটেল হিসাবে হোটেল গ্র্যান্ড সুলতান, রেইন ফরেস্ট রিসোর্ট তো আছেই।

দামের ব্যাপারে জানতে চাইলে সেক্ষেত্রে বলবো হোটেল এবং সার্ভিসের মান অনুযায়ী ৫০০/- থেকে শুরু করে ৫০০০/- এর মতো ভাড়া পড়তে পারে। এক্ষেত্রে আগেভাগেই প্রাইজ ঠিকঠাক করে হোটেল বুক করে রাখতে পারেন। 

মনে রাখবেন লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে ভালোভাবে ঘুরতে এবং ভ্রমণটিকে উপভোগ্য করতে রাত্রিযাপন করাটা বেশ জরুরি। সারাদিনের ক্লান্তি গুছাতে এবং উদ্যানের নতুন সকাল উপভোগ করতে অবশ্যই ওখানেই রাত্রিযাপনের চেষ্টা করবেন৷ 

ভ্রমণে কোথায় খাবেন 

ভ্রমণে এসে খাওয়া-দাওয়া হবে না তা কি হয়? তবে আফসোসের বিষয় হলো লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে ভালো কোনো খাবারের হোটেল বা দোকান নেই। এক্ষেত্রে আপনাদের খাবার-দাবার সাথে করেই নিয়ে যেতে হবে। 

চাইলে বাড়ি থেকে এসব খাবার সাথে করে উদ্যানে নিয়ে যেতে পারেন। অথবা সরাসরি শ্রীমঙ্গল থেকেই পছন্দের কোনো খাবার কিনে চলে যেতে পারেন উদ্যানে। 

লাউয়াছড়া উদ্যানের টিকিট ফি

কতৃপক্ষ লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে প্রবেশের ক্ষেত্রে আলাদা এটি টিকিট ফি বেঁধে দিয়েছে। এখানে যেতে হলে প্রাপ্তবয়স্ক ব্যাক্তিদের ২০ টাকা, স্কুল-কলেজের স্টুডেন্টদের ১০ টাকা, যদি কোনো প্রাইভেট যান থাকে তা পার্কিংয়ের জন্য ২৫ টাকা খরচ করতে হবে। 

পাশাপাশি ভ্রমনের সময় সাথে যদি কোনো গাইডের প্রয়োজন হয় তার খরচ বাবদ ২০০-৬০০/- এবং যদি উদ্যানের পিকনিক স্পট ব্যবহারের প্রয়োজন পড়ে সেক্ষেত্রে স্পট ফি বাবদ ২০ টাকার মতো খরচ হবে। 

ভ্রমণে সতর্কতা

  • যেহেতু এটি একটি গভীর বন সেহেতু ভ্রমণের সময় নিজের নিরাপত্তা নিজেকেই নিশ্চিত করতে হবে।
  • উদ্যান ভ্রমণের সময় রিজার্ভ পরিবহন সার্ভিস ব্যবহারের চাইলে লোকাল পরিবহন সার্ভিস নেওয়ার চেষ্টা করবেন, এতে করি খরচ বাঁচবে। 
  • বর্ষাকালে এই উদ্যানে ভ্রমণ না করাটাই ভালো।
  • লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ভ্রমণের শ্রেষ্ঠ সময় হলো শীতকাল। 
  • এটি যেহেতু একটু উদ্যান সেহেতু ভ্রমণের সময় নিরব থাকার চেষ্টা করবেন। এতে করে বণপ্রাণী বিব্রত হবে না। 
  • লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ভ্রমণে কখনোই কোনো অপরিচিত ব্যাক্তিকে সাথে নেবেন না এবং বনের গভীরে প্রবেশের সময় পরিচিত কোনো ব্যাক্তিকে সাথে রাখুন। 
  • লাউয়াছড়া উদ্যানের পাশাপাশি শ্রীমঙ্গলের অন্যান্য ঘোরার মতো প্লেইসগুলিকেও টার্গেটে রাখতে পারেন। 

ইতি কথা

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান হলো শ্রীমঙ্গল এবং সর্বোপরি বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান। পাশাপাশি এখানকার চা বাগান, চা কেবিন এবং চিড়িয়াখানার সৌন্দর্যও দেখার মতো। 

সুতরাং হাতে যদি সময় থাকে তবে এসব স্থানে ঘুরে আসতে পারেন৷ আর এই ঘোরাঘুরির ক্ষেত্রে পথঘাট ভালোভাবে দ্রুত চিনে ফেলতে লোকাল কোনো সিএনজিকে একদিনের জন্য রিজার্ভ করে নিতে পারেন৷ 

আর খাবার বা পানীয় হিসাবে শ্রীমঙ্গল ভ্রমণে এখানকার চা উপভোগ করতে ভুলবেন না। বিশেষ করে বিকালের সময়টাতে চা কেবিনে গিয়ে পছন্দের ক্যাটাগরির চা পান করে নেবেন। 

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান সম্পর্কিত প্রশ্ন ও উত্তর / FAQ

১. লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান কোথায় অবস্থিত?

উত্তরঃ লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের অবস্থান শ্রীমঙ্গলে। 

২. লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান কি ধরনের বনভূমি?

উত্তরঃ লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান মূলত চিরহরিৎ ক্যাটাগরি বা ধরনের বনভূমি।

৩. বাংলাদেশের জাতীয় উদ্যান কোনটি?

উত্তরঃ বাংলাদেশের জাতীয় উদ্যান হলো লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান।

৪. লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান কোন জেলায় অবস্থিত?

উত্তরঃ লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান শ্রীমঙ্গল জেলায় অবস্থিত।

আরও পড়ুন-

টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণ পরিকল্পনা

সিলেটের দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ

মন্তব্য করুন