রমনা পার্ক ভ্রমন গাইড, ইতিহাস ও ভ্রমণ অভিজ্ঞতা

রমনা পার্ক

বাংলাদেশের অন্যতম ব্যস্ত শহর ঢাকা- যার বুক ঘিরে প্রকৃতির মায়ায় নিবিড় শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য সেরা যে স্থানটি রয়েছে সেটি আমাদের সবার প্রিয় রমনা পার্ক। ১৬১০ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়া রমনা পার্ক মোঘল আমল থেকে এখন পর্যন্ত ঘটে যাওয়া নানা ঘটনার সাক্ষী।

এটিকে ব্যস্ততম ঢাকা নগরীর ফুসফুস বলা হয়। যানজট ও কোলাহলময় এই শহর আমাদেরকে ক্লান্ত-বিরক্ত করে তোলে। আর উচু উচু সব দালান যেন শান্তিতে নিঃশ্বাস নেয়ার সুযোগটাও কেড়ে নিয়েছে মানুষের কাছ থেকে।

তাই মুক্ত পরিবেশ, খোলা আকাশের স্বাদ গ্রহণ করার জন্য উপযুক্ত স্থান এই রমনা পার্ক।এর বর্তমান আয়তন ৬৮.৫০ একর। পুরানো হাইকোর্ট ভবন থেকে শুরু করে পূর্বের সড়ক ভবন পর্যন্ত মোঘলরা একটি বাগান তৈরি করেন।

পরবর্তীতে এটিকে পার্কে পরিণত করা হয় এবং ঢাকার প্রতিষ্ঠাতা মুঘল সুবাহদার ইসলাম খানই এর নামকরণ করেন ‘রমনা’।

আরও পড়ুনঃ বায়তুল মোকাররম মসজিদ

 রমনা পার্কের ইতিহাস

রমনা পার্ক

রমনা পার্কের ইতিহাস জানার আগে এর নামের অর্থ জানা যাক। রমনা অর্থ “সবুজ ঘাসে ঢাকা চত্বর”। আজকে আমরা যে পার্ক দেখছি সেটি এক-দুইদিনে গড়ে উঠেনি বরং এর পিছনে ৪১৪ বছরের অনেক পরিশ্রম, অনেক জল্পনা-কল্পনা, অনেক স্মৃতি।

এমনকি ইস্ট ইন্ডিয়ার শাসনামলে কত অযত্ন অবহেলা পোহাতে হয়েছে এই পার্ককে এবং পরিণত হতে হয়েছিল বন-জংগলে। এই পার্ক গড়ে ওঠার গল্পটা একটু শুরু থেকেই জানা যাক। হাইকোর্ট এলাকা, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এবং বর্তমানে রমনা পার্ক বলে আমরা যে এলাকাকে চিনি তা নিয়ে মুঘল আমলে গড়ে উঠেছিল রমনার বাগান।

এই বাগানটি বাগিচা বাগান নামে পরিচিত ছিল। বিশাল এলাকা জুড়ে ছিল এই বাগান। তবে এর যাত্রা শুরু হয় বাংলার সুবেদার ইসলাম খাঁর শাসনামলে আর তখন মোঘল সম্রাট ছিলেন জাহাঙ্গীর। শোনা যায়, তখন এটি একটি উদ্যান ছিল আর এই উদ্যানটি “বাগ-ই-বাদশাহী” নামে পরিচিত ছিল।

১৮২৪ সাল পর্যন্ত “বাগ-ই-বাদশাহী”নামেই পরিচিত ছিল আজকের রমনা পার্ক। ১৯০৮ সালে প্রাণের শহর ঢাকাকে বৃক্ষশোভিত শহরে সাজানোর পরিকল্পনা করেন প্রকৃতিপ্রেমী গভর্নর হেয়ার। তার এই পরিকল্পনা থেকে তিনি তার লন্ডনের বিখ্যাত ‘কিউই’ গার্ডেনের অন্যতম রূপকার রবার্ট লুইস প্রাউডলুককে অনুরোধ করে ঢাকায় নিয়ে আসেন।

যেহেতু এই এলাকাটি বিশাল ও সুন্দর ছিল তাই এই জায়গাটি রবার্ট লুইস প্রাউডলুকের বেশ পছন্দ হয় এবং তিনি পার্ক তৈরির কাজে লেগে যান। বলে রাখা ভালো যে,রবার্ট লুইস প্রাউডলুক-ই বর্তমান রমনা পার্কের স্থপতি।

বনপারুল, কাউয়াতুতি, পাদাউক, আগর, জ্যাকারান্ডা, তমাল, বাওয়াব, কর্পূর, জহুরিচাঁপা, কাশিয়া, জাভানিকা, মাধবী, মালতি, আফ্রিকান, টিউলিপ, অশোক, কেয়া, ফুরুস, পালাম, কাউফল, ঝুমকো, চন্দন, সেগুন, বট, কুসুম, কৃষ্ণচূড়া, গগন শিরিষ, কড়ই গাছ এই রকম ৭১টি উদ্ভিদ প্রজাতি দিয়ে সাজানো হয়েছিল পার্ক।

প্রায় ২০ বছর ধরে রবার্ট লুইস প্রাউডলুক তার নানা অভিনব পদ্ধতি দিয়ে সাজায়ে ছিলেন এই পার্ক।সেসময়টাই এর আয়তন ছিল ৮৯ একর। তবে সেই বিশাল এলাকা এখন নানা কারণে বিভক্ত হয়ে যায়। 

কি আছে রমনা পার্কে

সারাদিনের ক্লান্তিময় সময় থেকে স্বস্তি পেতে পার্কে অনেক কিছুই রয়েছে। যদিও এর যাত্রা শুরু হয়েছিল ৭১ প্রজাতি উদ্ভিদ দিয়ে তবে এখন এতে রয়েছে ২১১ টি প্রজাতির উদ্ভিদ।

এর মধ্যে রয়েছে ফল জাতীয় ৩৬ টি, ঔষধি প্রজাতির ৩৩ টি, কৃষি বনায়নের উদ্ভিদ প্রজাতি ৩টি, বনোজ উদ্ভিদ প্রজাতি ২টি, জলজ উদ্ভিদ প্রজাতি ২ টি, ফুল ও শোভা বর্ধক প্রজাতির ৮৭টি ও মসলা প্রজাতির উদ্ভিদ ৩টি।

নানা প্রজাতির গাছ থাকার কারণে নানারকমের পাখি এসে বাসা বাধে এই পার্কে।বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ছাত্র-ছাত্রী এখানে আসে বিভিন্ন প্রজাতির গাছ ও পাখির সাথে পরতিচিত হতে। এই পার্কে রয়েছে নানা বিরল প্রজাতির গাছ।

যেমনঃকনক চাঁপা, দুলি চাঁপা, চন্দন, পলাশ, মাকড়িশাল, লতা পারুল, বন আসরা, মহুয়া, ঝুমকো, কুর্চি, পালাম, স্থলপদ্ম, কাউ ফল , গোল্ডেন শাওয়ার, পাখি ফুল, উদয় পদ্ম,কেয়া, সহস্রবেলি, কফি, অশোক, আফ্রিকান টিউলিপ, মাধবী, কর্পূর,মালতি, ট্যাবেবুয়া, জহুরিচাঁপা, তমাল, ক্যাশিয়া জাভানিকা, পাদাউক, ধারমার, আগর, বাওবাব, কাউয়াতুতি (বনপারুল), জ্যাকারান্ডা।

নানা প্রজাতির গাছ-পালা ছাড়াও পার্কে রয়েছে শিশু প্রাঙ্গণ। শিশুদের বিনোদনের জন্য এখানে ঢেঁকি কল, দোলনা সহ আরো নানা রকমের খেলার উপকরণ আছে, যা শিশু মনকে আনন্দে ভরে দেয়। 

নতুন সাজে রমনা পার্ক 

করোনা যখন আমাদের কে এসে হানা দিলো, আমাদের জীবন-যাত্রাকে ঘর বন্দি করে দিল তখন ঢাকার এই ফুসফুসেও প্রভাব পড়ল। অযন্তে আবার সজীবতা হারাতে লাগল এই ফুসফুস। কিন্ত জীবনযাত্রা যখন একটু শিথিল হল তখন রমনা পার্ককে আবার পুনঃনিষ্কারণের ব্যবস্থা করা হলো। 

রমনাকে নতুন সাজে সাজাতে এইখানে তৈরি করা হয়েছে সিরামিক ইটের ওয়াকওয়ে।পার্কের ৪ নম্বর গেইট দিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়বে এই ওয়াকওয়ে। ওয়াকওয়ের দুইপাশে রয়েছে বাহারি রঙ্গের ফুল গাছ। শুধু কি তাই! রমনার সেই চিরচেনা লেকও সেজেছে নতুন সাজে।

এর সকল প্রকার ময়লা পরিষ্কার করে এটিকে পুনরায় খনন করা হয়েছে।লেক খনন করায় পানিতে ফিরেছে স্বচ্ছতা।লেকের পানিতে অক্সিজেনের মাত্রা ঠিক রাখতে বসানো হচ্ছে মেশিন। ৮.৭৬ একর লেকের দুইপাশে তৈরি করা হয়েছে ডেক, যেখানে কাঠের পাটাতনে করা হয়েছে হাঁটার ব্যবস্থা।

তার পাশাপাশি ময়লা-আবর্জনা ফেলার জন্য পার্কজুড়ে ২২০টি ডাস্টবিন বসানো হয়েছে।আরো রয়েছে আধুনিক ৯০০টি ল্যাম্পপোস্ট, আধুনিকায়নের জন্য সিমেন্টের বেঞ্চের ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং চারটি আধুনিক শৌচাগার নির্মাণ ও সংস্কার করা হয়েছে।

সুস্বাস্থ্যে রমনা

কি অবাক হচ্ছেন? সুস্বাস্থ্যে রমনা আবার কেমনে হয়? কেন হবে না বলেন তো! যুগ যুগ ধরে ঢাকার মানুষেরা এই রমনা পার্কেই তো সকাল- বিকাল হাটতে আসেন।রমনায় কিন্তু ব্যায়ামের সুব্যবস্থা আছে, আছে বিশ্রামের ব্যবস্থাও। 

ডা: শুভাগত চৌধুরী বলেছেন, “হাঁটা হলো সব ধরনের ব্যায়ামের মধ্যে সবচেয়ে উপকারী। স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে সবারই হাঁটা প্রয়োজন। নিয়মিত হাঁটার অভ্যাস রক্ত সঞ্চালন, ফুসফুস ও হৃৎপিণ্ডের কার্যক্রম বাড়ায়। হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমায়।

একজন মানুষের ৩০ মিনিট করে সপ্তাহে অন্তত পাঁচ দিন হাঁটা উচিত। যাদের হাঁটতে কষ্ট হয়, তারা বিরতি দিয়ে হাঁটতে পারেন।” আর ঢাকার ভিতরে মুক্ত বাতাসে হাঁটার সবচেয়ে উপযুক্ত স্থানই রমনা পার্ক।

নববর্ষে রমনা বটমূল

১৯৬৭ সাল থেকে আজ অব্দি বাংলা নববর্ষ পহেলা বৈশাখে প্রতিবছর ভোরে রমনা পার্কে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান হয়ে থাকে রমনার বটমূলে। এই অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নেয় “ছায়ানট”। পহেলা বৈশাখ বর্তমানে বাংলাদেশের একটি জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে।

পহেলা বৈশাখে ভোরে রমনা বটমূলে সর্বসাধারণ এসে বাংলা নববর্ষকে বরণ করে নেয় মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে । রমনার বটমূল এই দিন উৎসবের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। বিভিন্ন জায়গা থেকে নানান মানুষ এসে ভিড় জমান এই রমনার বটমূলে।

”এসো হে বৈশাখ, এসো এসো” এই গানে মুখরিত হয় পহেলা বৈশাখের রমনা বটমূলের সকাল। যান্ত্রিক জীবন থেকে বাচতে ঢাকার অনেক মানুষই ছুটে আসেন ঢাকার প্রানকেন্দ্র এই রমনা পার্কে। ছোট শিশু থেকে শুরু করে তরুণ, মধ্য বয়স্ক, বয়স্ক সকলেই উপভোগ করেন এই জায়গাটিকে।

যদিও কিছুটা অপরাধমূলক কাজ হয় এই পার্কে কিন্তু প্রশাসন এর বিরুদ্ধে কঠোর উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন।রমনা পার্ক আপনার মন ও শরীরকে সতেজ করে তুলতে বিশেষ অবদান রাখে। 

পরিশেষে

বাংলাদেশের সংস্কৃতি ও ইতিহাসের সাথে মিশে আছে রমনা পার্ক। এই পার্ক শুধুই একটি পার্ক নয় এটি অনেক ঘটনার সাক্ষী। প্রতিদিন হাজারো মানুষ এই পার্কে ঘুরতে আসে। এই পার্কে বসে পহেলা বৈশাখ এর বিশাল আয়োজন। তাই সবার এই পার্কের প্রতি যত্নশীল হওয়া উচিত।

রমনা পার্ক সম্পর্কিত প্রশ্ন ও উত্তর / FAQ

১। রমনা পার্ক কখন খোলা থাকে? 

উত্তরঃ রমনা পার্ক সপ্তাহে সাতদিনই খোলা থাকে এবং প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা অব্দি পার্ক খোলা থাকে। শুধুমাত্র শুক্রবার বিকাল ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬ টা অব্দি এটি খোলা থাকে।

২। রমনা পার্কের প্রবেশমূল্য কত? 

উত্তরঃ রমনা পার্ক জনসাধারনের প্রবেশের জন্য একদম ফ্রি। এখানে প্রবেশ করতে কোন টিকেট বা মূল্য দিতে হয় না। 

৩। কিভাবে যাবেন রমনা পার্ক ? 

উত্তরঃ আপনি যদি ঢাকায় থাকেন তবে ঢাকার যেকোন স্থান থেকে আপনি রিক্সা, সিএনজি, উবার অথবা আপনার এলাকা থেকে রমনাগামী যেকোন বাসে করেই আপনি এখানে আসতে পারবেন।

৪। রমনা পার্ক ঢাকার কোথায় অবস্থিত?

উত্তরঃ রমনা পার্ক সঠিক লোকেশন হলোঃ মাওলানা ভাসানী রোড,ঢাকা-১২১৭। তবে শুধু রমনা পার্ক বললেও আপনাকে যে কেউ সেখানে নিয়ে যেতে বা চিনিয়ে দিতে পারবেন।

আরও পড়ুন-

ছেড়া দ্বীপ

আলুটিলা গুহা

মন্তব্য করুন