গোলাপ গ্রাম – ভ্রমন গাইড ও দর্শনীয় স্থানসমুহ

গোলাপ গ্রাম 

স্বল্প খরচে একদিনের ভ্রমণের (Day-tour) জন্য চলে যেতে পারেন ঢাকার অদূরে সাভারের বিরুলিয়ায় অবস্থিত গোলাপ গ্রামে। সর্বত্রই গোলাপের সমারোহ, যেন এক গোলাপের স্বর্গরাজ্য। মূলত বিরুলিয়া ইউনিয়নের সাদুল্লাহপুর, শ্যামপুর এবং মোস্তাপাড়া গ্রামজুড়ে চাষ করা হয় বিভিন্ন প্রজাতির রং-বেরঙের গোলাপ।

তুরাগ নদের তীর ঘেষে মিরপুর বেড়িবাঁধের পশ্চিম পাশে সাদুল্লাহপুর, শ্যামপুর এবং মোস্তাপাড়া গ্রাম অবস্থিত। তবে সাদুল্লাহপুর গ্রামটিই বর্তমানে গোলাপ গ্রাম (Rose village) নামে পরিচিত। 

ইতিহাস সূত্রে জানা যায়, ভাওয়াল রাজার অধীনস্থ ছিল সাদুল্লাহপুর গ্রাম। যদিও রাজার কোনো বংশধর এই এলাকায় এখন নেই। তবে তার রেখে যাওয়া সম্পত্তি যে যেভাবে পারে তা ভোগ করছে। তখনকার আধিপত্য বিস্তারকারী রাজার রেখে যাওয়া শেষ বাড়িটার কিছুটা চিহ্ন এখনো আছে। তবে সেটিও এখন মানুষের দখলে আছে।

গোলাপ গ্রাম এর জনপ্রিয়তা বর্তমানে অনেক বেড়ে গিয়েছে। ঢাকার খুব কাছে হওয়ায় প্রতিদিন অনেক দর্শনার্থী আসে গোলাপ গ্রাম ঘুরতে। কম সময় এবং কম খরচে ঘোরার জন্য উত্তম জায়গা, যেখানে গেলে ফুলের সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করবেই। 

আরও পড়ুনঃ 

গোলাপ গ্রাম – কি দেখবেন 

গোলাপ গ্রাম

গোলাপ গ্রামে সারা বছর জুড়েই গোলাপের চাষ করা হয়। সেখানকার স্থানীয়দের প্রায় ৯০% লোকের পেশা হলো গোলাপ চাষ। গ্রামের আঁকাবাঁকা সরু পথের দুই পাশে বিস্তীর্ণ ফুলের বাগান। সবখানেই গোলাপের সৌরভ। শুধু জমিতেই চাষ নয়, গ্রামের প্রায় প্রতিটা বাড়ির আঙিনাতেও গোলাপ গাছের দেখা মিলবে।

লাল, সাদা, হলুদ বিভিন্ন রঙের গোলাপের দেখা মিলবে এখানে। উঁচু জমিতে মিরান্ডি জাতের গোলাপ চাষ বেশি করা হয়। অন্যান্য ফুলেরও চাষ হয় এখানে। যেমন: গ্লাডিওলাস, জারভারা, চন্দ্রমল্লিকা ইত্যাদি। চাইলে আপনি এই গ্রাম থেকে গোলাপ ফুল কিনতে পারবেন বাগান মালিকের সঙ্গে কথা বলে।

তবে উনারা অল্প সংখ্যক ফুল বিক্রি করতে চান না। কমপক্ষে ১০০-১৫০ টি ফুল কিনতে হবে। এখানকার চাষ করা গোলাপ বানিজ্যিকভাবে ঢাকাসহ সারাদেশেই সরবরাহ করা হয়। ঢাকা শহরের বেশিরভাগ ফুলের চাহিদা মেটানো হয় এই গ্রাম থেকেই। বিরুলিয়া ব্রীজ বা মিরপুরের দিয়াবাড়ি থেকে নৌকা করে যারা সাদুল্লাহপুর গ্রামে যাবেন, তাদের জন্য নৌভ্রমণ খুবই উপভোগ্য হবে।

কারণ নদীপথে যাওয়ায় পথে চোখে পরবে নদীর দুই পাশের ফসলি জমি, শস্যক্ষেত ও হাসের খামার। গোলাপ গ্রামের সৌন্দর্য হেঁটেই উপভোগ করতে পারবেন। অথবা রিকশা ভাড়া করতে পারবেন ঘন্টা হিসেবে। রিকশা ভাড়া প্রতি ঘন্টায় ১০০ টাকা। 

গোলাপের হাট 

গোলাপ গ্রামেই গোলাপ ফুলের বেচাকেনা বেশ জমে ওঠে। তাইতো স্থানীয় ফুল চাষীরা নিজেদের প্রয়োজনে এই গ্রামেই গড়ে তুলেছেন গোলাপের হাট। প্রতিদিন সন্ধ্যায় শ্যামপুর গ্রামে গোলাপের হাট বসে। সেই গ্রামের আবুল কাশেম মার্কেটের সামনে ফুল ব্যবসায়ীদের আনাগোনা শুরু হয় সন্ধ্যার দিকে। সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বেচাকেনা হয় ফুলের।

ফুল কেনাবেচা করার জন্য মোস্তাপাড়া গ্রামেও আছে সাবু মার্কেট। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার ফুল ব্যবসায়ীরা এখানে আসেন ফুল নিতে। প্রায় সারা বছরই গোলাপ ফুলের চাহিদা থাকে। যার কারণে ফুল চাষীরাও সারা বছর ব্যস্ত থাকেন।

উৎসবের দিনগুলোতে ফুলের চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। যেমন: স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, বিয়ের প্রোগ্রাম ইত্যাদি। এসব দিনে ফুলের দামও ২-৩ গুণ বেড়ে যায়। 

গোলাপ গ্রাম – কিভাবে যাবেন 

বিভিন্ন রুটে আপনি গোলাপ গ্রামে যেতে পারবেন। তবে বিরুলিয়া ব্রীজ এর রুট ধরে গেলে রাস্তার দুই পাশে গোলাপ বাগানের দেখা মিলবে। বিভিন্ন জায়গায় অটো থামিয়ে বাগানগুলো কভার করতে পারবেন। 

উত্তরা – গোলাপ গ্রাম

উত্তরা হাউস-বিল্ডিং এর নর্থ টাওয়ারের নিকট থেকে লেগুনায় করে সোনারগাঁ জনপথ ধরে দিয়াবাড়ি যেতে হবে। তারপর একটু সামনে এগিয়ে মেইনরোডে লোকাল গাড়িতে চড়ে যাবেন বিরুলিয়া ব্রীজ। সেই ব্রীজ থেকে অটোতে করে (ভাড়া ২০ টাকা) সাদুল্লাহপুর চলে যাবেন।

বিরুলিয়া ব্রীজ নৌপথেও যেতে পারবেন। একা যেতে পারেন বা অনেকে সাথে থাকলে নৌকা রিজার্ভ করতে পারেন। রিজার্ভ করলে নৌকা ভাড়া হবে ৫০০ টাকার মতো। একটি নৌকায় বসতে পারবেন মোট ২৫ জন। 

টঙ্গী – গোলাপ গ্রাম

টঙ্গী থেকে যেতে হলে প্রথমে টঙ্গী স্টেশন থেকে সিএনজি রিজার্ভ করে কামারপাড়া হয়ে বিরুলিয়া ব্রীজ যেতে হবে। বিরুলিয়া ব্রীজ থেকে অটো ভাড়া করে চলে যাবেন সাদুল্লাহপুর। অটো ভাড়া জন প্রতি ২০ টাকা। সরাসরি সাদুল্লাহপুরের অটো পেতে সমস্যা হলে, প্রথমে ১০ টাকা ভাড়া দিয়ে আকরান বাজারে যাবেন। এরপর সেখান থেকে অন্য অটোতে করে সাদুল্লাহপুর যাবেন। 

যাত্রাবাড়ী, গুলিস্তান, ফার্মগেট – গোলাপগ্রাম

যাত্রাবাড়ী, গুলিস্তান বা ফার্মগেট থেকে মিরপুর বেরিবাঁধে যাওয়ার জন্য বাস সার্ভিস আছে। এছাড়াও মিরপুর-১, মিরপুর-১০ বা গাবতলী থেকে রিক্সায় সহজেই চলে যেতে পারবেন দিয়াবাড়ি বটতলা ঘাটে। অথবা সিএনজি চালিত অটোরিকশা বা টেক্সিক্যাবেও যেতে পারবেন দিয়াবাড়ি বটতলা ঘাটে।

দিয়াবাড়ি ঘাট থেকে শ্যালো ইঞ্জিনের নৌকা সাদুল্লাহপুরের দিকে ছেড়ে যায় প্রতি ১০ মিনিট অন্তর। এছাড়াও স্পিডবোট, শ্যালো নৌকা, কোষা নৌকা চুক্তিতে ভাড়া নিয়ে যেতে পারবেন গোলাপগ্রাম। এক্ষেত্রে স্পিডবোট ভাড়া ৫০০ টাকা, শ্যালো নৌকা ভাড়া ২৫০ টাকা, কোষা নৌকা ভাড়া ৩০০ টাকা। 

সাভার – গোলাপ গ্রাম

সাভার থেকে যাওয়ার জন্য চৌরংগী মার্কেটের সামনে থেকে লেগুনা বা মিনি বাসে করে আকরান বাজারে যাবেন। সাভার / নবীনগর / জিরাবো থেকে আলিফ বা মোহনা পরিবহনে উঠে বিরুলিয়া ব্রিজে নামবেন। অটোতে করে আকরান বাজার থেকে সাদুল্লাহপুর চলে যাবেন। এই পথে নিজস্ব পরিবহনেও যাওয়া যাবে। 

বিশেষ দ্রষ্টব্য : নৌকা চলাচল সন্ধ্যা ৬ টার পর বন্ধ হয়ে যায়। যারা নৌ পথে ফিরে আসতে চান, অবশ্যই খেয়ালরাখবেন সময়ের মধ্যেই আসার। 

কোথায় খাবেন 

সাদুল্লাহপুর ঘাট এর কাছে কয়েকটি সাধারণ মানের হোটেল রয়েছে। দুপুরের খাবার সেখানে খেতে পারবেন। তবে অনেক মানুষ একসঙ্গে গেলে খাবার নাও পেতে পারেন। সেক্ষেত্রে খাবার অর্ডার করলে কিছুটা সময়ের মধ্যে তারা রান্না করে দিবে। এছাড়া স্ন্যাকস জাতীয় খাবারের জন্য কয়েকটি ঝুপড়ি চায়ের দোকান রয়েছে।

সেখান থেকে হালকা খাবার খেতে পারেন। হোটেলের খাবার খেতে না চাইলে বাসা থেকেও রান্না করে নিয়ে যেতে পারেন। সঙ্গে শুকনো খাবারও সাথে রাখতে পারেন। 

গোলাপ গ্রাম – ভ্রমণ টিপস 

  • যারা সাঁতার জানেন না তাদের জন্য নৌপথে গোলাপ গ্রাম না যাওয়াই ভালো। 
  • গ্রামের মানুষকে বিরক্ত করবেন না এবং তাদের অসুবিধা হয় এমন কোন কাজই করবেন না। 
  • গোলাপ বাগান থেকে ফুল ছিড়বেন না। বর্তমানে গোলাপ গ্রামে বাগান গুলোর চারপাশে নীল রঙের নেট দেওয়া আছে। 
  • গোলাপ গ্রামে ভালো খাবারের দোকান নেই। তাই সবচেয়ে ভালো হয় খাবার সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়া। 
  • যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা ফেলবেন না। 

শেষকথা 

যান্ত্রিক জীবনের ব্যস্ততা থেকে কিছুটা সময় মুক্তির জন্য আমরা ছুটে যাই বিভিন্ন দর্শনীয় জায়গায়। তবে আর্থিক সমস্যার কারণে অনেকেই দূরে যেতে পারেন না। গোলাপ গ্রাম ঢাকার খুব কাছেই হওয়ায় খুব কম সময় এবং কম টাকাতেই ঘুরে আসতে পারবেন। ডে-টুরের জন্য উত্তম জায়গা হচ্ছে গোলাপ গ্রাম। সেখানে গেলে মনে হবে যেন গোলাপের রাজ্যে চলে গেছেন।

গোলাপ ফুলের রিং কারো মাথায়, কারো আবার খোপায় গোঁজা গোলাপ। প্রিয় মানুষটিকে গোলাপ ফুল উপহার দিতেও ভুল করছেন না অনেকে। গোলাপ ফুলের এই অভূতপূর্ব সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য আপনিও চলে যেতে পারেন সাভারের গোলাপ গ্রামে।

আজকের আর্টিকেলটি কেমন লাগলো তা অবশ্যই কমেন্ট বক্সে জানাবেন। ধন্যবাদ সাথে থাকার জন্য। 

গোলাপ গ্রাম সম্পর্কিত প্রশ্ন এবং উত্তর / FAQ

১. গোলাপ গ্রামে যাওয়ার উত্তম সময় কখন? 

উত্তর: গোলাপ গ্রামে সারা বছর জুড়ে গোলাপ চাষ হলেও গোলাপের দাপট তেমন থাকে না সবসময়। গোলাপ ফুল ফোটার সেরা সময় হচ্ছে শীতকাল। এই সময় ফুলের সমারোহ যেমন বেশি থাকে, তেমনি ফুল পরিস্ফুটিতও হয় অনেক বড় আকারে। তাই গোলাপ গ্রামে যাওয়ার উত্তম সময় হচ্ছে শীতকাল। 

২. গোলাপ গ্রাম কোথায় অবস্থিত? 

উত্তর : ঢাকার অদূরে সাভারের বিরুলিয়া ইউনিয়নের সাদুল্লাহপুর, শ্যামপুর এবং মোস্তাপাড়া গ্রামজুড়ে চাষ করা হয় বিভিন্ন প্রজাতির গোলাপ ফুল। তবে সাদুল্লাপুর গ্রামটিই বর্তমানে গোলাপ গ্রাম নামে পরিচিত। 

আরও পড়ুন-

আলাদিন পার্ক

আলুটিলা গুহা

মন্তব্য করুন