বায়তুল মোকাররম মসজিদ

বায়তুল মোকাররম মসজিদ

ঢাকার প্রাণকেন্দ্র গুলিস্তানের নিকট পল্টনে অবস্থিত বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম মসজিদ’(Baitul Mukarram Masjid)। মসজিদের ইতিহাস থেকে জানা যায়, ঢাকায় অধিক মুসল্লি ধারণক্ষমতা সম্পন্ন একটি বড় মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা নেয় তৎকালীন পাকিস্তানের বাওয়ানি পরিবার।

সেই সূত্র ধরে, বাওয়ানি জুট মিলসের মালিক পাকিস্তানের বিশিষ্ট শিল্পপতি লতিফ বাওয়ানি ও তাঁর ভাতিজা ইয়াহিয়া বাওয়ানি মসজিদটি নির্মাণের উদ্যোগ নেন। ১৯৫৮ সালে ‘বায়তুল মুকাররম মসজিদ সোসাইটি’ গঠনের মাধ্যমে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়।

মসজিদের নকশা প্রণয়ন করেন সিন্ধুর বিশিষ্ট স্থপতি এ এইচ থারানি। স্থান হিসেবে নির্বাচন করা হয় পুরান ও নতুন ঢাকার মিলনস্থল পল্টনে ৯ একর জমি। যা পল্টন পুকুর ছিল। ২৭ জানুয়ারি ১৯৫৯ সালে পুকুরটি ভরাট করার মধ্য দিয়ে মসজিদের নির্মাণকাজ শুরু হয়, শেষ হয় ১৯৬২ সালে।

৩০ হাজার মুসল্লি ধারণক্ষমতা সম্পন্ন এই মসজিদটির নকশাতে ভিন্নতা আনার জন্য মসজিদটির নকশা মক্কার কাবা ঘরের আদলে চারকোনা আকৃতির করা হয়েছে। অন্যান্য মসজিদের মতো নকশায় সংযোজিত হয়নি কোন গম্বুজ। বর্তমানে বায়তুল মোকাররম মসজিদ আটতলা।

নিচতলায় বিপণিবিতান ও গুদামঘর। মসজিদের দোতলা থেকে খতিব নামাজ পড়ান। তবে দোতলা থেকে ছয়তলা পর্যন্ত প্রতিটি তলায় নামাজ পড়া হয়। তিনতলার উত্তর পাশে নারীদের নামাজ পড়ার ব্যবস্থা রয়েছে । উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্ব দিক থেকে মসজিদে প্রবেশ করা যায়।

আরও পড়ুনঃ মহেশখালী দ্বীপ, কক্সবাজার

বায়তুল মোকাররম মসজিদ – ইতিহাস 

৬০ বছরেরও সময় আগে একটি পরিবারের উদ্যোগে প্রায় সাড়ে আট একর জমির ওপর নির্মাণ করা হয় এই মসজিদ। এটি বাংলাদেশের সব মুসলমানের কাছে এক অন্যরকম মর্যাদার স্থান হয়ে উঠেছে।  পুরোনো এবং নতুন ঢাকার মিলনস্থল পল্টন এলাকায় এই মসজিদটি তৈরি করা হয়েছিল সেই সময়। জানা যায়, বর্তমানে বায়তুল মোকাররম মসজিদ এ একসঙ্গে ৪০ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে সক্ষম। 

পাকিস্তান আমলে ঢাকায় বড় শিল্প উদ্যোক্তা বাওয়ানি পরিবারের পক্ষ থেকে এত বড় মসজিদটি নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ১৯৫৯ সালে ‘বাওয়ানি জুট মিলস’-এর মালিক উর্দুভাষী আব্দুল লতিফ বাওয়ানি ও তার ভাতিজা ইয়াহিয়া বাওয়ানি এই মসজিদ নির্মাণের প্রকল্প হাতে নিয়েছিলেন। তিনি ‘বায়তুল মোকাররম মসজিদ সোসাইটি’ গঠন করেন। 

ইতিহাসবিদ শরিফ উদ্দিন আহমেদ কর্তৃক সম্পাদিত ঢাকা কোষ থেকে জানা যায়, ১৯৬০ সালের ২৭ জানুয়ারি আব্দুল লতিফ বাওয়ানি মসজিদ নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। তার ২ বছর পর ১৯৬২ সাল নাগাদ মসজিদ নির্মাণের মূল কাজ মোটামুটি শেষ হয়।

তবে সম্পূর্ণ মসজিদের কাজ শেষ হয় ১৯৬৮ সালে। পাকিস্তানের সিন্ধুর একজন স্থপতি এ এইচ থারানি মসজিদটির নকশা প্রণয়ন করেছেন। ১৯৬৩ সালে বায়তুল মোকাররম মসজিদে প্রথম নামাজ পড়া শুরু হয় এবং ১৯৬৪ সাল থেকে বায়তুল মোকাররম মার্কেট চালু হয়।

প্রথম নামাজ আদায়

মসজিদের শহর ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে বিশাল আয়তন ও সুরম্য স্থাপনা নিয়ে আজকের যে বায়তুল মোকাররম দাঁড়িয়ে আছে, ১৯৬৩ সালের ২৩ জানুয়ারি সেখানে প্রথম নামাজ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। যদিও মসজিদের নির্মাণ ২৭ জানুয়ারি ১৯৬০ সালে শুরু হয়ে ১৯৬৮ সাল পর্যন্ত চলেছিল।

বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম ৮.৩০ একর জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং আয়তন ২৬৯৪.১৯ বর্গ মিটার। বায়তুল মোকাররম মসজিদটির সর্বোচ্চ গম্বুজের উচ্চতা ৩০.১৮ মিটার।

মসজিদের প্রবেশ পথগুলো রাস্তা থেকে ৯.৯ ফুট উঁচুতে অবস্থিত।

বাইতুল মোকাররম মসজিদ এর যাত্রা 

সেই সময় পাকিস্তানের বিশিষ্ট শিল্পপতি আবদুল লতিফ ইব্রাহিম বাওয়ানি এবং তাঁর ভাতিজা ইয়াহইয়া বাওয়ানি বায়তুল মোকাররম মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ নেন। সে অনুযায়ী ১৯৫৯ সালে ‘বায়তুল মোকাররম মসজিদ সোসাইটি’ গঠন করেন। মসজিদ নির্মাণের জন্য ৮.৩০ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়।

তৎকালীন পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান মসজিদটির নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন। মসজিদ কমপ্লেক্সের নকশা সিন্ধুর বিশিষ্ট স্থপতি আবদুল হুসেন থারিয়ানিকে। পুরো কমপ্লেক্স নকশার মধ্যে দোকান, অফিস, গ্রন্থাগার ও গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৬৩ সালের ২৫ জানুয়ারি (শুক্রবার) প্রথমবারের মতো এখানে নামাজ পড়া হয়।

আধুনিকায়ন ও সম্প্রচার 

২০০৮ সালে সৌদি আরবের আর্থিক সহায়তায় বায়তুল মোকাররমের আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ হয়। ফলে মুসল্লি ধারণ ক্ষমতা ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজারে উন্নীত হয়। এখন বায়তুল মোকাররম মসজিদ আটতলা। নিচতলায় বিপণিবিতান ও গুদামঘর। দোতলা থেকে ছয়তলা পর্যন্ত প্রতি তলায় নামাজ পড়া হয়।

সব মিলিয়ে মুসল্লিরা বায়তুল মোকাররম মসজিদের এক লাখ ২৫ হাজার ৬২ বর্গফুট এলাকা ব্যবহার করেন। এ ছাড়া নারীদের জন্য রয়েছে ছয় হাজার ৩৮২ বর্গফুট নামাজের জায়গা।

বায়তুল মোকাররম মসজিদ – পরিচালনা ও স্থাপত্যশৈলী

১৯৭৫ সালের ২৮ মার্চ থেকে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের রক্ষণাবেক্ষণ করে আসছে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত বায়তুল মোকাররমে সাতজন খতিব নিয়োগ পেয়েছেন। বিশিষ্ট আলেমে দ্বিন মাওলানা আবদুর রহমান কাশগরি (রহ.) ছিলেন বায়তুল মোকাররমের প্রথম খতিব।

স্থাপত্যশৈলী

বায়তুল মোকাররমের মূল অবকাঠামো কাবাঘরের আদলে তৈরি। তবে আধুনিক স্থাপত্য রীতিতে তৈরি এ মসজিদের নকশায় মোগল স্থাপত্যশৈলীর ছাপ রয়েছে। মূল নকশা অনুযায়ী, মসজিদের প্রধান প্রবেশপথ পূর্ব দিকে হওয়ার কথা থাকলেও উত্তর ও দক্ষিণ গেট দুটোই বেশি ব্যবহূত হয়।

দক্ষিণ ও উত্তর পাশে ওজু করার জায়গা রয়েছে। উত্তর ও দক্ষিণ দিকে, মসজিদে প্রবেশ করার বারান্দার ওপর দুটি ছোট গম্বুজ নির্মাণের মাধ্যমে প্রধান ভবনের ওপর গম্বুজ না থাকার অভাব ঘোচানো হয়েছে। সমগ্র মসজিদজুড়েই অলংকরণের আধিক্যকে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।

মুজিববর্ষে আইনি স্বীকৃতি প্রত্যাশা

বায়তুল মোকাররম মসজিদ বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ হিসেবে খ্যাত হলেও এর কোনো আইনি স্বীকৃতি নেই। কিন্তু মুজিববর্ষ উপলক্ষে সরকার বায়তুল মোকাররমকে জাতীয় মসজিদ হিসেবে আইনি স্বীকৃতি দেবে বলে গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়।

প্রয়াত ধর্ম প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শেখ মো. আবদুল্লাহ এ বিষয়ক একটি প্রস্তাবের সার-সংক্ষেপ অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানোর কথা গণমাধ্যমকে জানিয়ে ছিলেন। ফলে চলতি বছরে জাতীয় মসজিদের স্বীকৃতি পাবে বলে প্রত্যাশা দেশের সাধারণ মুসল্লিদের।

শেষ কথা

বায়তুল মোকাররম মসজিদটি স্থাপত্যিক রীতিতে আধুনিক। তবে এটি প্রচলিত মসজিদ স্থাপত্যের প্রধান বৈশিষ্ট্যকে এড়িয়ে যায়নি। এর অবয়ব মক্কার কাবা শরীফের মতো হওয়ার কারণে মুসলমানদের হূদয়ে জায়গা করে নিয়েছে। আশা করছি আমাদের আজকের এই আর্টিকেলটি আপনাদের ভালো লেগেছে। এতক্ষণ আমাদের সাথে থাকার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। আল্লাহ হাফেজ।

বায়তুল মোকাররম মসজিদ সম্পর্কে প্রশ্ন ও তার উত্তর / FAQ

প্রশ্ন ১: বায়তুল মোকাররম মসজিদের অপর নাম কি? 

উত্তর:- বাংলাদেশের জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররম মসজিদ,আরবি নাম। রাজধানী ঢাকার প্রাণকেন্দ্র পল্টনে অবস্থিত এই বায়তুল মোকাররম মসজিদটি। মসজিদটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয় ১৯৬৮ সালে।

প্রশ্ন ২: বায়তুল মোকাররমের প্রথম খতিবের নাম কি?

উত্তর:- বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের প্রথম খতিব ছিলেন মুফতিয়ে আজম সাইয়েদ মুহাম্মদ আমীমুল ইহসান বারাকাতী (রহ.) (১৯৬৪-১৯৭৪)। বৃহস্পতিবার বাদ আসর রাজধানীর পুরান ঢাকার কুলুটোলা জামে মসজিদে মুফতি আমীমুল ইহসান একাডেমির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয় ওরস মাহফিল উনার (মৃত্যুবার্ষিকী) উপলক্ষে। 

প্রশ্ন ৩: বায়তুল মোকাররম মসজিদে কত সালে সালাত আদায় করা শুরু হয়েছিল? 

উত্তর:- ঢাকা শহরে প্রাণকেন্দ্রে বিশাল আয়তন ও সুরম্য স্থাপনা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে আজকের এই বাইতুল মোকাররম মসজিদটি। ১৯৬৩ সালের ২৩ জানুয়ারি বায়তুল মোকাররম মসজিদে প্রথম নামাজ অনুষ্ঠিত হয়েছিল।  

প্রশ্ন ৪: মসজিদের সভাপতির কাজ কি? 

উত্তর:- মসজিদের সভাপতি কাজ হচ্ছে –

১. অনুমোদনক্রমে মসজিদ পরিচালনা পর্ষদের সভা আহ্বান করিবেন এবং সভার কার্যবিবরণী প্রস্তুত ও সংরক্ষণ করিবেন। 

২. সংশ্লিষ্ট সম্পাদকের সহিত পরামর্শ ক্রমে মসজিদের বার্ষিক পরিকল্পনা, বাজেট প্রস্তুত ও পেশ করিবেন। 

৩. সামগ্রিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সকলকে উৎসাহ প্রদান করিবেন। 

আরও পড়ুন-

বড় কাটরা

সোনাদিয়া দ্বীপ

মন্তব্য করুন