বাহাদুর শাহ পার্ক

বাহাদুর শাহ পার্ক 

বহু ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক। রাজধানী ঢাকার ঐতিহাসিক স্থান গুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হলো বাহাদুর শাহ পার্ক। এটি পুরান ঢাকার সদরঘাট এলাকার লক্ষ্মীবাজারে অবস্থিত একটি উদ্যান।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠিক বিপরীত পার্শ্বে অবস্থিত এই পার্কটির সাথে জড়িয়ে আছে অনেক ইতিহাস। পার্কটির বর্তমান নাম বাহাদুর শাহ পার্ক হলেও পূর্বে কিন্তু তা ছিলো না। প্রথমে এর নাম ছিল আন্টাঘর, পরবর্তীতে ভিক্টোরিয়া পার্ক এবং বর্তমানে বাহাদুর শাহ পার্ক।

সিপাহী বিদ্রোহের করুণ সাক্ষী ঐতিহাসিক এই পার্ক। ডিম্বাকৃতির এই পার্ক পূর্বে লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরাও করা ছিলো। কিন্তু পুনর্নির্মাণ করে জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। চতুর্দিকে টাইলস করা বসার জায়গা এবং সুন্দর পরিপাটি টয়লেটের ব্যবস্থা করা আছে।

পুরো জায়গা জুড়ে পাথর বিছানো হয়েছে যেনো বৃষ্টির দিনে স্যাঁতস্যাঁতে না হয়। কোনো রেলিং নেই তবুও পূর্ব এবং পশ্চিম পার্শ্বে গেট আছে। বাহাদুর শাহ পার্ক সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো আজকের আর্টিকেলে। তাহলে চলুন শুরু করা যাক।

আরও পড়ুনঃ শরীয়তপুরের দর্শনীয় স্থান

বাহাদুর শাহ পার্ক – বর্ণনা 

ঢাকার অন্যতম প্রধান নৌবন্দর সদরঘাট এলাকায় প্রবেশ করতেই লক্ষীবাজারের ঠিক মাথায় অবস্থিত ঐতিহাসিক বাহাদুর শাহ পার্ক। এই পার্ক ঘিরে একত্রিত হয়েছে সাতটি রাস্তা। এর চারপাশে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্থাপনা সহ রয়েছে বেশ কিছু স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়।

এই পার্কের উত্তর পাশে আছে সেন্ট থমাস চার্চ এবং ঢাকার প্রথম পানি সরবরাহ করার জন্য তৈরি ট্যাংক। পার্কের উত্তর-পূর্ব কোণায় আছে ঢাকার অন্যতম কলেজ কবি নজরুল সরকারি কলেজ এবং ইসলামিয়া হাই স্কুল। পূর্ব পাশে আছে ঢাকার অন্যতম প্রাচীন বিদ্যালয় সরকারি মুসলিম স্কুল।

দক্ষিণ-পশ্চিম কোণায় আছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। এর ঠিক উত্তর-পশ্চিম পাশে অবস্থিত ঢাকার জজ কোর্ট। বাংলা বাজার, ইসলামপুর শাখারী বাজারের মতো ঢাকার অন্যতম বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ এলাকা থেকে বর্তমান ঢাকার নতুন এলাকায় আসার জন্য পার্ক এলাকার রাস্তাটাই হচ্ছে প্রধান সড়ক। 

বাহাদুর শাহ পার্ক – নামকরণ 

বর্তমান বাহাদুর শাহ পার্ক চত্বরে ১৮ শতকের শেষের দিকে ঢাকার আর্মেনীয়দের বিলিয়ার্ড ক্লাব ছিল। এই বিলিয়ার্ড ক্লাবকে স্থানীয়রা নাম দিয়েছিল “আন্টাঘর”। স্থানীয়রা বিলিয়ার্ড বলকে আন্টা নামে অভিহিত করতো। বিলিয়ার্ড ক্লাব ঘরের সাথেই ছিল একটি ময়দান। সেই ময়দানটি আন্টাঘর ময়দান নামে পরিচিত ছিল তখন।

রানী ভিক্টোরিয়া ১৮৫৮ সালে ভারতবর্ষের শাসনভার গ্রহণ করেন। রানী ভিক্টোরিয়ার শাসনভার গ্রহণ সংক্রান্ত ঘোষণা এই ময়দানেই পাঠ করে শোনান ঢাকা বিভাগের কমিশনার। তখন থেকে এই স্থানের নামকরণ হয় ভিক্টোরিয়া পার্ক। এই পার্কটি ১৯৫৭ সালের পূর্ব পর্যন্ত ভিক্টোরিয়া পার্ক নামেই পরিচিত ছিল।

১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর প্রহসনমূলক এক বিচারে ইংরেজ শাসকেরা অসংখ্য বিপ্লবী সিপাহীকে ফাঁসি দেয়। তারপর জনগণকে ভয় দেখানোর জন্য সিপাহীদের লাশ এনে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় এই মাঠ বা ময়দানের বিভিন্ন গাছের ডালে।

১৯৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের শতবার্ষিকী পালন করা উপলক্ষে এখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। তখন পার্কের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বাহাদুর শাহ পার্ক। দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ এর নামানুসারে এই পার্কের নামকরণ করা হয়। 

বাহাদুর শাহ পার্ক – ইতিহাস 

বর্তমান বাহাদুর শাহ পার্কের জায়গাটি উনিশ শতকের প্রথম দিকে ইংরেজরা কিনে নেয়। তারপর এই জায়গাটিকে একটি পার্কের রূপ দেয় তারা। এর চারদিকে লোহা দিয়ে ঘেরাও করে চার কোণায় চারটি দর্শনীয় কামান স্থাপন করা হয়। সেই স্থানটি জীর্ণ হয়ে গেলে তা ভেঙে নওয়াব আব্দুল গণির উদ্যোগে একটি ময়দানের মতো তৈরি করা হয়। জেমস্ টেলরের বর্ণনা অনুযায়ী, ১৮৪০ সালেও সেখানে ছিল কয়েকটি রাস্তার মাঝে এক টুকরা খালি জায়গায় বৃত্তাকার একটি বাগান। 

ক্লাবঘরের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ঢাকার নবাব আব্দুল গণি এবং নবাব আহসান উল্লাহ। এই ক্লাবে ইংরেজরা বিলিয়ার্ড ছাড়াও টেনিস ও ব্যাডমিন্টন খেলতো। ইংরেজদের আড্ডার জায়গা ছিল এই ক্লাব। ঢাকা ক্লাবের ইতিহাস এবং পুরানো নথিপত্র অনুযায়ী আন্টাঘর ময়দানের কাছে ছিল ঢাকা ক্লাবের এক একর জমি (সূত্রপুর মৌজা: খতিয়ান: ৬১৪, প্লট: ৬৬৪-৬৬৫)।

পুরানো কর্মচারীদের মতে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত ঢাকা ক্লাব এই এলাকার তিন একর জমির জন্য খাজনা প্রদান করত। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ঘোড়দোড় আয়োজন এবং অন্য প্রয়োজনের জন্য ইংরেজরা ঢাকা ক্লাবকে শাহবাগ এলাকায় স্থানান্তরিত করেন। 

ইংরেজ মেরিন সেনারা ১৮৫৭ সালের ২২শে নভেম্বর ঢাকার লালবাগ কেল্লায় অবস্থিত দেশীয় সেনাদের নিরস্ত্র করার লক্ষ্যে আক্রমণ চালিয়েছিল। কিন্তু সিপাহীরা তখন বাধা দিলে যুদ্ধ বেধে যায়। সেই যুদ্ধে আহত এবং পালিয়ে যাওয়া সেনাদের ধরে এনে এক সংক্ষিপ্ত কোর্ট মার্শালের মাধ্যমে দোষী সাব্যস্ত করে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।

সেই বিচারের পর ১১ জন সিপাহীকে আন্টাঘর ময়দানে প্রকাশ্যে জনসম্মুখে ফাঁসি দেওয়া হয়। স্থানীয় লোকদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করার জন্য বহুদিন যাবত লাশগুলো সেখানকার গাছে ঝুলিয়ে রাখা হয়।

বাহাদুর শাহ পার্ক – স্মৃতিসৌধ 

সিপাহী বিদ্রোহের ১০০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ১৯৫৭ সালে “ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট” (DIT) এর উদ্যোগে বাহাদুর শাহ পার্কে নির্মাণ করা হয় একটি স্মৃতিসৌধ। স্মৃতিসৌধটি চারটি পিলারের উপর দাঁড়ানো চারকোনা একটি কাঠামো। এর ওপরে রয়েছে একটি ডোম। অপর পাশে আছে একটি ওবেলিস্ক। ওবেলিস্কটি ব্রিটিশ সাম্রাজ্য এবং ভারতবর্ষের সম্রাজ্ঞী হিসেবে রানী ভিক্টোরিয়ার সিংহাসনে আরোহণের কথা মনে করিয়ে দেয়। 

সিপাহী বিদ্রোহ দমন করার পর ইংরেজরা তাদের সেনাদের স্মরণে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করেন আন্টাঘর ময়দানে। আর্মেনীয়দের ক্লাবঘরের চার কোণায় বসানো চারটি সীমানা নির্দেশক ব্রিটিশ কামাণ পরবর্তীতে তুলে এনে এই পার্কের চারিদিকে বসানো হয়। বাহাদুর শাহ পার্কটির উন্নয়নে নবাব আব্দুল গণির ছিলো ব্যক্তিগত অবদান। 

খাজা হাফিজুল্লাহ স্মৃতিস্তম্ভ 

ঢাকার নবাব স্যার খাজা আহসানুল্লাহর জ্যেষ্ঠ পুত্র ছিলেন খাজা হাফিজুল্লাহ। ঢাকার পরবর্তী নবাব খাজা হাফিজুল্লাহ হবেন এমনটি চিন্তা করে সবাই তাকে সমীহ করতেন এবং অতি যত্নে লালন-পালন করতেন। কিন্তু ১৮৮৪ সালে তার অকাল মৃত্যুতে নবাব পরিবার তথা পুরো ঢাকা শহরই শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে। নবাব স্যার খাজা আহসানুল্লাহ পুত্রশোকে অসুস্থ হয়ে পড়েন।

যার কারণে ইংরেজদের বিনোদনের পৃষ্ঠপোষক নবাব স্যার খাজা আহসানুল্লাহ তাদের আমোদ ফুর্তির জন্য আয়োজন করতেন না। সেই সময় ইংরেজ নবাবরা সান্তনা দেওয়ার জন্য এবং খাজা হাফিজুল্লাহর স্মৃতিকে জীবিত রাখার উদ্দেশ্যে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য তার পরিচিতিমূলক একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করেন। 

তার বৃহদাকার স্মৃতিস্তম্ভ জাহাজে করে আনা হয় তৎকালীন ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে। স্মৃতিস্তম্ভটি গ্রানাইট পাথরের তৈরি। এর চারপাশ মসৃণ এবং চকচকে। পরিচিতিমূলক লিপি খোদাই করা রয়েছে গোড়ার দুইদিকে। ১৮৮৫ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে চারটায় বঙ্গের ছোট লাট সাহেব এক আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে স্মৃতিস্তম্ভটি উদ্বোধন করেন। 

কিভাবে যাবেন 

বাহাদুর শাহ পার্ক পুরান ঢাকায় অবস্থিত। তাই এখানে যাওয়ার জন্য প্রথমেই দেশের যেকোনো স্থান থেকে আগে ঢাকায় যেতে হবে। রাজধানী ঢাকার মহাখালী থেকে আজমেরী পরিবহন এবং স্কাইলাইন বাস পার্কে সরাসরি এসে দাঁড়ায়। গাবতলী হতে ৭ নম্বর এবং সাভার পরিবহন বাস পার্ক পর্যন্ত যায়।

সায়দাবাদ থেকে রিকশা বা উবারে যেতে পারবেন এই পার্কে। ট্রেনে করে ঢাকায় গেলে কমলাপুর থেকে উবার বা রিক্সা করে যেতে পারবেন। এছাড়া লঞ্চে এলেও সদরঘাট টার্মিনাল থেকে মাত্র পাঁচ মিনিট হাঁটলেই পেয়ে যাবেন বাহাদুর শাহ পার্ক। 

শেষকথা 

ভারতীয় উপমহাদেশ তথা বাংলাদেশে ব্রিটিশদের ঔপনিবেশিক শাসনামলের স্মৃতি বিজড়িত বাহাদুর শাহ পার্ক। এই পার্কটি ঢাকার ঐতিহ্য এবং গৌরব বহন করে আসছে। যেহেতু পার্কটিতে কোন টিকিট মূল্য নাই, তাই সকাল বিকেল অনেকেই বেড়াতে আসেন এখানে। হাঁটাহাঁটি আর আড্ডায় সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকে এই পার্ক।

বাহাদুর শাহ পার্কের কাছেই আছে সদরঘাট, আহসান মঞ্জিল, বিউটি বোর্ডিং। এছাড়াও পুরান ঢাকা খাবারের জন্য অনেক বেশি বিখ্যাত। সেখানকার কাচ্চি বিরিয়ানি, তেহারি, লাচ্চি, আগুন পান আরো হরেক রকম বাহারি খাবারের স্বাদ নিতেও ভুলবেন না। যারা ঐতিহাসিক স্থান ভ্রমণ করতে পছন্দ করেন তারা একবার হলেও বাহাদুর শাহ পার্কে যেতে পারেন। 

বাহাদুর শাহ পার্ক সম্পর্কিত প্রশ্ন এবং উত্তর / FAQ’s 

১. বাহাদুর শাহ পার্ক কোথায় অবস্থিত? 

উত্তর : পুরান ঢাকার সদরঘাট এলাকার লক্ষ্মীবাজারের ঠিক মাথায় অবস্থিত বাহাদুর শাহ পার্ক।

২. বাহাদুর শাহ পার্কের প্রবেশ মূল্য কত? 

উত্তর : বাহাদুর শাহ পার্কের কোনো প্রবেশ মূল্য নেই। এই পার্ক জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত।  

৩. বাহাদুর শাহ পার্ক খোলা এবং বন্ধের সময়সূচি কখন? 

উত্তর : বাহাদুর শাহ পার্কের পশ্চিম দিকের প্রবেশদ্বার বন্ধ রাখা হয়। এর পূর্ব দিকের প্রবেশদ্বার ২৪ ঘন্টাই খোলা থাকে। 

৪. বাহাদুর শাহ পার্কের প্রথম নাম কি?  

উত্তর : বাহাদুর শাহ পার্কের প্রথম নাম “আন্টাঘর”। 

৫. বাহাদুর শাহ পার্ক কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে অবস্থিত? 

উত্তর : বাহাদুর শাহ পার্ক জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে অবস্থিত।

আরও পড়ুন-

বজরা শাহী মসজিদ নোয়াখালী

তেওতা জমিদার বাড়ি মানিকগঞ্জ

মন্তব্য করুন