মহেশখালী দ্বীপ, কক্সবাজার

মহেশখালী

চট্টগ্রাম বিভাগের কক্সবাজার জেলার বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি উপজেলা হলো এই মহেশখালী। এই উপজেলাটি মূলত বাংলাদেশের একমাত্র পাহাড়ি দ্বীপ যেখানে জনবসতি গড়ে উঠেছে, উপজেলা হিসাবে স্বীকৃত হয়েছে। মোট ৩৮৮.৫০ বর্গকিমি বা ১৫০.০০ বর্গমাইলের এই উপজেলাটিতে বর্তমানে জনসংখ্যার পরিমাণ ৩,২১,২১৮ এর মতো।

কক্সবাজার জেলা সদর থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার পথ পেরুলেই এই উপজেলাটির অবস্থান। উপজেলাটি ১৯৮৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর তারিখে যাত্রা শুরু করে বিভিন্ন দিক দিয়ে সারা দেশে জনপ্রিয় হয়ে আছে।

যেহেতু এই উপজেলাটি তিনটি ছোট ছোট দ্বীপের সমন্বয়ে গঠিত সেহেতু এতে দর্শনীয় স্থানের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়।

আরও পড়ুনঃ ঢাকেশ্বরী মন্দির (পলাশী ব্যারাক) ঢাকা

মহেশখালী স্থানের ইতিহাস 

প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের কারণে একসময় সৃষ্টি হয় এই দ্বীপ বা উপজেলার। যা ঘটে ১৫৫৯ খ্রিষ্টাব্দের দিকে এবং এই বিষয়টি প্রথম জনসম্মুখে আনে অধ্যাপক ড. সুনীতি ভূষণ কানুনগোর। সাগরের মাঝখানে অবস্থিত এই দ্বীপটির প্রতি প্রথম নজর পড়ে ইংরেজদের। তাদের নজরে আসার সাথে সাথেই তারা দ্বীপটি বন্দোবস্ত সংক্রান্ত সিস্টেমে নিয়ে আসে। ধারণা করা হয় প্রায় ২০০ বছর আগে বৌদ্ধ সেন মহেশ্বরের নামে এই উপজেলার নামকরণ করা হয়। 

মহেশখালী দর্শনীয় স্থান 

মজার ব্যাপার হলো এই উপজেলায় দর্শনীয় স্থানের সংখ্যা প্রায় দেখার মতো। তাছাড়া স্থানটির উত্তর দিক থেকে দক্ষিণ দিক পর্যন্ত ২টি পাকা সড়কের ব্যবস্থা করার কারণে নিয়মিত অসংখ্য দর্শক জড়ো হয়। আর এসব স্থানে যাতায়াত করার ক্ষেত্রে দর্শনার্থীরা সহজেই জীপ, অটোরিক্সা, ট্রাক, টেম্পোর মতো যান ব্যবহার করতে পারে।

তাছাড়া যারা সড়কপথে যাতায়াত করতে পছন্দ করেন তারা কক্সবাজার হতে মহেশখালী পর্যন্ত ৭ কিলোমিটারের জলপথ ব্যবহার করতে পারেন৷ আর যারা এর বিভিন্ন দূর্যোগ নিয়ে ভয়ভীতিতে আছেন তারা মহেশখালী সংলগ্ন এলাকায় প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন স্টর্ম সেন্টারের সাহায্য নিতে পারেন। মহেশখালীর দর্শনীয় স্থানগুলো হলো: 

সোনাদিয়া দ্বীপ

মহেশখালী উপজেলার কুতুবজম ইউনিয়নে এই দ্বীপটির অবস্থান। অনেকেই এই দ্বীপটিকে প্যারাদ্বীপ নামেও ডেকে থাকে। দৈর্ঘের হিসাবে এই দ্বীপ প্রায় ৯ বর্গ কিলোমিটারের বিশাল একটি দ্বীপ। 

মৈনাক পাহাড় 

মহেশখালীর অন্য আরেকটি জনপ্রিয় স্থানের নাম হলো মৈনাক পাহাড়। বাংলাদেশের একমাত্র পাহাড়ি দ্বীপ হিসাবে এই মৈনাকের খ্যাতি বিশ্বজোড়া। দর্শনীয় আদিনাথ মন্দিরের টানেই অনেকে এই মৈনাক পাহাড়ের চূড়ায় উঠে। এই স্থানটি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কাছে বেশ গুরুত্বের সাথেই বিবেচিত হয়ে থাকে। 

লিডারশীপ ইউনিভার্সিটি কলেজ

মহেশখালীর অন্য আরেকটি জনপ্রিয় দর্শনীয় স্থান হলো এই লিডারশীপ ইউনিভার্সিটি কলেজ। এই ইউনিভার্সিটির সৌন্দর্যের টানে বর্তমানে শত শত দর্শনার্থী ভিড় জমায় এই প্রতিষ্ঠানটিতে। 

আদিনাথ মন্দির

কক্সবাজার থেকে ১২ কিমি দূরে এই আদিনাথ মন্দিরের অবস্থান। মন্দিরটিকে অনেকেই শিব মন্দির হিসেবেও চিনে থাকে। হিন্দু ধর্মগ্রন্থ, রামায়ণ, পুরাণ ও ঐতিহাসিকদের বর্ণনা থেকে জানা যায় এটি তৈরি হয়েছিলো প্রায় হাজার বছর পূর্বে। 

স্বর্ণমন্দির 

বুদ্ধের বিশাল মূর্তিসহ পাহাড়ের উপরে সুদৃশ্য পরিবেশে তৈরি করা হয়েছে সোনায় মোড়া বৌদ্ধ মন্দির। আর এটির নামকরণ করা হয়েছে স্বর্ণমন্দির। শুধুমাত্র একটি মূর্তিই নয়! বরং এর পাশাপাশি গৌতম বুদ্ধের বিভিন্ন মূর্তিও চোখে পড়বে এই স্থানে। 

শ্যুটিং স্পট

মহেশখালীতে বেড়াতে গিয়ে দর্শনার্থীগণ যে স্থানটি একবার হলেও উপভোগ করেন সেটি হলো শ্যুটিং স্পট। যার পাশেই রয়েছে ম্যানগ্রোভ বন৷ এখানে একটি মনোরম ব্রিজও রয়েছে। যার পরিবেশ আপনাকে মোহিত করবে। 

মহেশখালীতে কিভাবে যাবেন

সড়ক পথে ও আকাশ পথে শুরুতেই আপনাকে যেতে হবে কক্সবাজারে। এক্ষেত্রে সড়ক পথে ১৬০০ টাকা থেকে শুরু করে ২০০০ টাকা পর্যন্ত লাগতে পারে৷ এরপর কক্সবাজার লাবণী পয়েন্ট থেকে জেটিতে উঠতে হবে। এই স্থান থেকে ট্রলার বা বোটে চড়ে ৭০/৮০ টাকাতে যেতে হবে মহেশখালী। তাছাড়া নদীপথে নিয়মিত মালবাহী ট্রলার, স্পীডবোট, যাত্রীবাহী লঞ্চ, নৌকা চলে। 

মহেশখালী ভ্রমণে কি দেখবেন

মহেশখালী উপজেলার পশ্চিম দিকে বঙ্গোপসাগর থাকায় এখানে গড়ে উঠা বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্র আপনাকে মুগ্ধ করবে৷ এসব পর্যটন কেন্দ্রের মধ্যে রয়েছে মাতার বাড়ী কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মাতার বাড়ী সমুদ্র সৈকত, আদিনাথ মন্দির, বড় রাখাইন পাড়া, বৌদ্ধ মন্দির, লিডারশীপ ইউনিভার্সিটি কলেজ, আদিনাথ ওগোরকঘাটা জেটি, লবণ মাঠ, শুটকি মহাল,

গোরকঘাটা জমিদারবাড়ী, উপজেলা পরিষদ দীঘি, সোনাদিয়া দ্বীপ ও সমুদ্র সৈকত, ধলঘাটা হাঁসের চর, শরইতলা সী-বিচ, চরপাড়া সী-বিচ, মৈনাক পাহাড়, প্যারাবন, চিংড়ী ঘের, মুদির ছড়া, ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট বন, মুদির ছড়া রাখাইন ছাড়া এবং রাখাইন বুদ্ধমন্দির, মুদির ছড়ার বটগাছসহ অন্যান্য স্থান। যারা মহেশখালীতে ভ্রমণের প্ল্যান করছেন তারা উপরোক্ত দর্শনীয় স্থানগুলি থেকে ঘুরে আসতে পারেন।

তাছাড়া এই অঞ্চলে মহেশখালী উপজেলার লোকসংস্কৃতি ও লোক উৎসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আদিনাথ মেলাও উপভোগের সুযোগ রয়েছে। হাঁড়ি পাতিল, কলসি, হাতা, ধুছনী, লোহার তৈরি দা-বটিসহ বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী জিনিসপত্র এখানে বিক্রি করা হয়ে থাকে।

আরও পড়ুনঃ পদ্মা রিসোর্ট (লৌহজং, মুন্সীগঞ্জ)

মহেশখালী ভ্রমণ খরচ

এবার আসি খরচের ব্যাপারে। যারা ঢাকা থেকে কক্সবাজার হয়ে মহেশখালী যাবেন তাদের বাস ভাড়া হিসাবে এই রুটে খরচ হবে ৯০০-২৫০০ টাকার মতো। আর যারা বিমানে একই রুট ব্যবহার করতে চান তাদের গুনতে হবে ৪৬০০ টাকা থেকে শুরু করে ১২,০০০ টাকা পর্যন্ত।

কক্সবাজার থেকে আবার কস্তুরী ঘাট অথবা ৬ নং ঘাট এলাকা হয়ে ট্রলার ও স্পিড বোর্ট যোগে মহেশখালী যেতে লাগবে ৭০/৮০ টাকা। আর যারা মহেশখালী ঘুরে বেড়াতে চান তারা একটা রিকশা বা ইজিবাইক ভাড়া করে ২/৩ জন মিলে ১৫০/৩৫০ টাকা খরচ করে পুরো মহেশখালী ঘুরে বেড়াতে পারবেন। 

মহেশখালী ভ্রমণে কোথায় থাকবেন

মহেশখালী ভ্রমণের ক্ষেত্রে আসলে ১ দিনের বেশি সময় লাগবে না। তবুও যদি রাত কাটানোর প্রয়োজন পড়ে সেক্ষেত্রে কক্সবাজারের যেকোনো আবাসিক হোটেলে উঠে পড়তে পারেন। নিচে কিছু আবাসিক হোটেল আইডিয়া দিলাম: 

কক্সবাজার হোটেল সায়মন: কক্সবাজার হোটেল সায়মনের ভাড়া ৫ হাজার থেকে শুরু করে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত হতে পারে৷ 

ওশান প্যারাডাইস হোটেল: এই ওশান প্যারাডাইস হোটেলে এক দিনের রুম ভাড়া ৮০০০ থেকে ১৭০০০ টাকা হয়ে থাকে৷ 

হোটেল সী প্যালেস: সর্বনিম্ন রুম ভাড়া ৩০০০ টাকা। আবার মহেশখালী উপজেলা থেকে এর দূরত্বও বেশ কাছে। 

সার্ফ ক্লাব রিসোর্ট হোটেল: এখানে আপনি সাধারণ রুম পাবেন ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকায়। আবার ৩ হাজার টাকায় ৩ থেকে ৪ টি বেডের এর রুমও এই হোটেলে পাওয়া যাবে। 

মহেশখালী ভ্রমণে কোথায় খাবেন

মহেশখালীতে যেহেতু ঘোরাঘুরি করতে খুব একটা সময় লাগে না সেহেতু মহেশখালীতে যাওয়ার আগে ভারী খাবার খেয়ে নিতে পারেন। মাঝখানে মহেশখালীতে হালকা নাস্তা করাটাই উত্তম। আর যাদের মহেশখালীতে খেতেই হবে তারা মিডিয়াম বাজেট নিয়ে ঢুকে পড়তে পারেন রোদেলা, ঝাউবন কিংবা নিরিবিলি ইত্যাদি হোটেলে।

এখানে ভাতের দাম মাত্র ২০ টাকা বা ২৫ টাকার মতো। বিভিন্ন সবজির পাশাপাশি এখানে আপনি চাইলে ১৫০/২০০ টাকাতে গরুর মাংসও খেতে পারবেন। আর যাদের হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানি পছন্দ তারা মাত্র ২০০ টাকাতে হ্যান্ডি রেস্তোরাঁয় এই বিশেষ বিরিয়ানি টেস্ট করতে পারেন। আশা করি ভালো লাগবে। 

শেষ কথা

যারা মহেশখালী ঘুরতে যাবেন তারা ১/২ দিনেই ফিরে আসতে পারেন। ঘোরাঘুরির পাশাপাশি এই উপজেলায় থেকে আপনি আদিনাথ মেলা উপলক্ষে আয়োজিত নাটক, যাত্রা, সার্কাস, পুতুল নাচ ইত্যাদি অনুষ্ঠান উপভোগ করার সুযোগ পাবেন। যেহেতু এই মেলায় দেশীয় পণ্যের পসরা বসে সেহেতু কম মূল্যে ভালো পণ্যও কেনার সুযোগ থাকবে।

হরিণ, বানর, গুটিকয়েক সাপ আর শীতের মৌসুমে অল্প কিছু পরিযায়ী পাখিও উপভোগ করার সুযোগ রয়েছে। যদিও নির্বিচারে বনভূমি ধ্বংসের কারণে মহেশখালী প্রতিনিয়ত তার আসল সৌন্দর্য হারাতে বসেছে।

মহেশখালী সম্পর্কিত প্রশ্ন ও উত্তর / FAQ’s

১. মহেশখালী কিসের জন্য বিখ্যাত?

উত্তরঃ মহেশখালী মুক্তার গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের জন্য বিখ্যাত।

২. মহেশখালী দ্বীপ কোথায়?

উত্তরঃ মহেশখালী দ্বীপ চট্টগ্রাম বিভাগের কক্সবাজার জেলায়।

৩. মহেশখালী উপজেলা চেয়ারম্যানের নাম কি? 

উত্তরঃ মহেশখালী উপজেলা চেয়ারম্যানের নাম হলো আলহাজ্ব মোহাম্মদ শরীফ বাদশা।

আরও পড়ুন- 

পল্লী কবি জসিম উদ্দিনের বাড়ি

চাঁদপুরের দর্শনীয় স্থান

 

মন্তব্য করুন