লালন শাহ
“স্রষ্টার সৃষ্টিকে ভালবাসলে পক্ষান্তরে স্রষ্টাকেই ভালোবাসা হয়।” কথাটি গানের মাধ্যমে বলেছিলেন সাধক লালন শাহ। আধ্যাত্মিক সংগীত বা বাউল সংগীত যাদের পছন্দ তাদের কাছে লালন শাহ একটি আবেগের নাম।
লালনের (lalon) গানের জাদুতে (lalon geeti) মগ্ন হয়ে জান লালন প্রেমীরা। আজ আপনাদেরকে পরিচয় করিয়ে দিব আধ্যাত্মিক সাধক, বাউল সাধনার প্রধান গুরুর মাজার সম্পর্কে। এটি কুষ্টিয়া জেলায় অবস্থিত।
মন আমার গেল জানা ।
কারো রবে না এ ধন জীবন যৌবন
… তবেরে কেন এত বাসনা;
একবার সবুরের দেশে বয় দেখি দম কষে
উঠিস নারে ভেসে পেয়ে যন্ত্রণা ।
বাউল গুরু লালন শাহ এর জন্মস্থান ছিল কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার ছেউড়িয়া গ্রামে। ছেউরিয়া গ্রামেই তিনি তার শিষ্যদের নীতি ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা দিতেন। ফকির লালন শাহ (lalon) মৃত্যুবরণ করলে তার নিজ বাসস্থানেই তাকে সমাধিস্থ করা হয়। সমাধিস্থলেই তার মৃত্যুর পর গড়ে ওঠে মিলনক্ষেত্র বা লালনের আখড়া।
আরও পড়ুনঃ টুঙ্গিপাড়া বঙ্গবন্ধুর বাড়ি
লালন শাহ পরিচয়
লালন শাহ (Lalon) এর জন্মস্থান নিয়ে রয়েছে বিতর্ক। সূত্রে পাওয়া যায়, বাউল গানের শ্রেষ্ঠ রচয়িতা লালন শাহ ১১৭৯ বঙ্গাব্দের ১ কার্তিক (১৭৭২) ঝিনাইদহ জেলার হরিণাকুন্ডু উপজেলার হরিশপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। অন্য সূত্র হতে জানা যায়, লালন ফকির (lalon) কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী ইউনিয়নের ছেউরিরা গ্রামে ১৭৭৪ সালে এক কায়স্থ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
এই তথ্যটি প্রকাশিত হয় তার মৃত্যুর দুই সপ্তাহ পরে “হিতকরী” পত্রিকার (১৮৯০) একটি সংবাদ নিবন্ধে। বাবা শ্রী মাধব কর এবং মা শ্রীমতি পদ্মাবতীর একমাত্র সন্তান ছিলেন। শৈশবকালেই লালন তার বাবাকে হারান। মায়ের আদর স্নেহেই বেড়ে ওঠেন তিনি।
কথিত আছে, যৌবনকালে লালন শাহ একবার তীর্থস্থানে বের হয়েছিল পথিমধ্যে বসন্ত রোগে আক্রান্ত হন। তার সঙ্গীরা মৃত ভেবে তাকে পরিত্যাগ করে চলে যায়। এই দুরাবস্থায় সিরাজ সাঁই নামে একজন মুসলমান ফকির তাকে বাড়িতে নিয়ে যান এবং সুস্থ করে তোলেন। পরবর্তীতে লালন (lalon) সিরাজ সাঁইয়ের নিকট বাউল ধর্মে দীক্ষিত হন। এরপর ছেউরিয়াতে একটি আখড়া নির্মাণ করে স্ত্রী ও শিষ্য সহ বসবাস করতে শুরু করেন।
নিজের গানে (lalon geeti) তিনি নিজেকে “লালন ফকির” হিসেবে আখ্যায়িত করেন । নিজের আখড়ায় বাংলা ১২৯৭ সালের ১লা কার্তিক (১৮৯০ সালের ১৭ই অক্টোবর) মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিল ১১৬ বছর । মৃত্যুর পর ছেউরিয়াতেই শিষ্যরা গড়ে তোলেন তার মাজার। এটি লালনের আখড়া (lalon) নামে পরিচিত।
লালন শাহ মাজার (লালনের আখড়া)
মাজারটি লালন শাহ (lalon) মাজার বা লালনের আখড়া নামে পরিচিত। লালনের কবরস্থানকে মাজার হিসেবে “লালন শাহ মাজার” ১৯৬৩ সালে নির্মাণ করা হয়। উদ্বোধন করেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান । মাজার থেকে কিছুটা দূরে রয়েছে একটি ফটক।
মাজার থেকে বেরিয়ে সামনে এগুলে দেখতে পাবেন লালনের (lalon) আবক্ষমূর্তি। ২০০৪ সালে সেখানে নির্মাণ করা হয় আধুনিক মানের অডিটোরিয়াম সহ একাডেমিক ভবন। বর্তমানে মাজারের মালিক লালন একাডেমি।
লালন শাহ মাজার কুষ্টিয়া শহর হতে ৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। কুষ্টিয়া শহরের সাথে সড়ক পথে সংযুক্ত মাজারটি। লালন শাহ মাজারের পাশে রয়েছে লালন মিউজিয়াম। মিউজিয়ামে লালন শাহ (lalon) এর একটি দরজা, বসার জলচকি, ভক্তদের ঘটি-বাটি এবং বেশ কিছু দুর্লভ ছবি সংরক্ষিত আছে।
মিউজিয়ামের প্রবেশ মূল্য মাত্র ২ টাকা। রাত্রিযাপনের জন্য মাজারে রয়েছে একটি রেস্ট হাউস। মাজার সংলগ্ন দোকানগুলোতে রয়েছে কারুকাজে পরিপূর্ণ বিভিন্ন রকমের হস্তশিল্পের সমাহার। এখানে গেলে দেখতে পাবেন কালিগঙ্গা নদীর নয়নাভিরাম দৃশ্য।
লালন মেলা / লালন উৎসব
প্রত্যেক বছর দুই বার লালন মেলা (Lalon Mela) অনুষ্ঠিত হয়। দোল পূর্ণিমা উৎসবের সময় একবার এবং বাংলা কার্তিক মাসের ১ তারিখে একবার লালনের আখড়ায় অনুষ্ঠিত হয় লালন উৎসব। ১লা কার্তিক লালন সাঁই এর মৃত্যু বার্ষিকী। মেলায় সারাদেশ থেকে লালনের শিষ্যদের আগমন ঘটে।
মেলা উপলক্ষে লালন শাহ মাজারকে (Mausoleum of Lalon Shah) সাজানো হয় রঙ্গিন করে। আলোকসজ্জা করা হয়, তোরণ নির্মাণ এবং বিশাল ছামিয়ানা টানানো হয় মেলা উপলক্ষে। তিন দিনব্যাপী এই বিশাল মেলায় চলে রাতভর বাউল গানের উৎসব (lalongeeti)।
এসব দেখি কানার হাট বাজার
বেদবিধির পর শাস্ত্র কানা
আর এক কানা মন আমার ৷৷
মহাত্মা উপাধি
মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ বিশ্বাস করতেন না লালন ফকির। মানবতাবাদী লালন দর্শন এর মূল কথা মানুষ। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উদ্বুদ্ধ এবং জাত, ধর্ম, কূল, বর্ণ, লিঙ্গ ইত্যাদি অনুসারে মানুষের ভেদাভেদ তিনি বিশ্বাস করতেন না। তিনি ছিলেন বিশিষ্ট বাঙালি আধ্যাত্মিক নেতা, মরমী কবি, দার্শনিক এবং সমাজ সংস্কারক।
মরমী সাধক লালন শাহের গান ও দর্শন যুগে যুগে প্রভাবিত করেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, এলেন গিন্সবার্গের মতো বহু খ্যাতনামা কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, দার্শনিক সহ অনেক মানুষকে। গান্ধীজীরও ২৫ বছর আগে ভারত উপমহাদেশে সর্বপ্রথম সাধক লালন শাহ কে “মহাত্বা” উপাধি দেওয়া হয়েছিল ।
লালনের মৃত্যুর ১২ দিন পর তৎকালীন পাক্ষিক পত্রিকা “হিতকরী” তে প্রকাশিত একটি রচনায় তাকে “মহাত্মা” হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় । রচনাটির লেখক এর নাম ছিল রাইচরণ। মীর মশাররফ হোসেন ছিল হিতকরী পত্রিকার সম্পাদক।
আরও পড়ুনঃ খাগড়াছড়ি জেলার দর্শনীয় স্থান
কিভাবে যাবেন
লালন শাহ মাজারে যেতে হলে প্রথমে বাংলাদেশের যে কোন প্রান্ত হতে কুষ্টিয়া যেতে হবে।
বাসে ঢাকা-কুষ্টিয়া : রাজধানী ঢাকার গাবতলী অথবা টেকনিক্যাল মোড় থেকে ঢাকা-কুষ্টিয়া মহাসড়কে বেশ কিছু বাস চলাচল করে । যেমন- শ্যামলী, হানিফ, সোহাগ, নিউ এসবি সুপার ডিলাস্ক, খালেক পরিবহন । বাস থেকে কুষ্টিয়ার মজমপুর গেটে নেমে যাবেন। সেখান থেকে রিক্সা বা অটোরিক্সা ভাড়া করে চলে যাবেন লালন শাহ মাজারে। ভাড়া জনপ্রতি নন-এসি ৪৫০-৬৫০ টাকা এবং এসি ১০০০-১২০০ টাকা।
ট্রেনে ঢাকা-কুষ্টিয়া : ট্রেনে কুষ্টিয়া যেতে চাইলে সুন্দরবন এক্সপ্রেস (কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে ছাড়ে) এবং চিত্রা এক্সপ্রেসে ( ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন থেকে ছাড়ে) যেতে পারেন। ট্রেন কুষ্টিয়ায় পোড়াদহ স্টেশনে থামবে। এই দুটি ট্রেন কুষ্টিয়া শহরের কোর্ট স্টেশনে থামেনা। পোড়াদহ স্টেশন থেকে বাস অথবা অটোরিক্সায় করে কুষ্টিয়া শহরে আসতে হবে। এক্ষেত্রে ভাড়া লাগবে ২০ থেকে ৪০ টাকা।
- সুন্দরবন এক্সপ্রেস : ঢাকা থেকে ছাড়ে সকাল ৬ঃ২০ মিনিটে এবং পোড়াদহে পৌঁছায় রাত ১২ঃ৫৭ মিনিটে। মঙ্গলবার ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে।
- চিত্রা এক্সপ্রেস : ঢাকা থেকে ছাড়ে সকাল ৭ টায় এবং পোড়াদহে পৌঁছায় রাত ১২ঃ২০ মিনিটে। সোমবার ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে।
আসনভেদে ট্রেনের টিকেট মূল্য ৩৬০ টাকা থেকে ৮২৮ টাকা। কুষ্টিয়া শহর থেকে যেকোনো রিক্সা বা অটোরিক্সায় চড়ে সরাসরি চলে যাবেন লালন শাহ মাজারে।
কোথায় থাকবেন
কুষ্টিয়া শহরে থাকার জন্য পেয়ে যাবেন মানসম্মত কিছু হোটেল। উল্লেখযোগ্য কিছু হোটেলের তালিকা দেওয়া হল –
- হোটেল আল-আমিন (০১৭-৫৪১৯৩)
- আজমিরী হোটেল (০১৭-৫৩০১২)
- দেশা গেস্ট হাউস (০১৭২০-৫১০২১২)
- হোটেল রিভার ভিউ (০১৭-৭১৬৬০)
- হোটেল গোল্ড স্টার (০১৭-৬১৬৭৫)
- হোটেল পদ্মা
- হোটেল সানমুন
কোথায় খাবেন
কুষ্টিয়ায় খাওয়ার জন্য রয়েছে অনেক ভালো মানের রেস্টুরেন্ট। কোর্ট স্টেশন এলাকায় রয়েছে হোটেল শফি।। এছাড়াও রয়েছে খাওয়া-দাওয়া, জাহাঙ্গীর হোটেল, শিল্পী হোটেলে ইত্যাদি। কুষ্টিয়া গেলে অবশ্যই বিখ্যাত তিলের খাজা এবং কুলফি মালাই খেতে ভুলবেন না।
শেষ কথা
বাউল সম্রাট লালন শাহ (lalon) এর গান গুলো (lalon geeti) ১৯ শতকে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। বাউল গানের অগ্রদূতদের মধ্যে অন্যতম একজন হিসেবে বিবেচনা করা হয় তাকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কুষ্টিয়ার শিলাইদহে অবস্থানকালে লালন শাহের ২৯৮ গান (lalongeeti) সংগ্রহ করেন এবং তার মধ্যে ২০ টি গান প্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশ করেন।
এছাড়াও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মানবধর্ম বিষয়ক প্রবন্ধ ও বক্তৃতাতে লালন শাহের গানের (lalon geeti) উল্লেখ করেছেন। কুষ্টিয়ায় লালনের আখড়া বা লালন শাহ মাজার ছাড়াও রয়েছে বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ি, মীর মশাররফ হোসেনের বাস্তুভিটা, টেগর লজ, গড়াই নদীর তীরে রেনইউক বাদ উল্লেখযোগ্য। কুষ্টিয়া গেলে অবশ্যই এসব জায়গার ঘুরে দেখতে ভুলবেন না।
আরও পড়ুন-
মধুটিলা ইকোপার্ক, শেরপুর
কুসুম্বা মসজিদ , নওগাঁ