কুসুম্বা মসজিদ
বাংলাদেশের প্রধান ধর্ম ইসলাম। মুসলমানদের ইবাদতের জন্য মসজিদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্থান। আমাদের দেশে রয়েছে জানা অজানা অনেক মসজিদ। এরই মধ্যে আজকে আপনাদেরকে পরিচয় করিয়ে দিব সুলতানি আমলের ঐতিহ্যবাহী কুসুম্বা মসজিদ।
ঐতিহাসিক এই কুসুম্বা মসজিদ এর চিত্র দেখতে পাবেন ৫ টাকার নোটে। প্রায় ৫০০ বছর পুরানো এই মসজিদটি এখনো টিকে আছে নওগাঁর বুকে। নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলায় অবস্থিত প্রাচীন এই মসজিদ (Kusumba Mosque)।
আফগানি শুর বংশের শাসক গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহ এর আমলে সুলাইমান নামক এক ব্যক্তি প্রাচীন এই মসজিদটি নির্মাণ করেছিলেন। সুলাইমান ছিলেন ধর্মান্তরিত হওয়া এক মুসলিম। এর নির্মাণকাল ১৫৫৮-১৫৫৯ খ্রিষ্টাব্দ ( ৯৬৬ হিজরী)।
মসজিদটি ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। মসজিদের উত্তর দক্ষিণ দিকে রয়েছে একটি বিশাল দিঘি (৭৭ বিঘা বিশিষ্ট)। গ্রামবাসী এবং মুসলমানদের খাবার পানি, গোসল এবং ওযুর প্রয়োজন মেটানোর জন্য দিঘিটি তৈরি করা হয়েছিল। সুলতানি আমলের এই পুরাকীর্তিটির আরেক নাম কালাপাহাড়। স্থানীয়দের কাছে কালাপাহাড় নামেই পরিচিত এটি।
আরও পড়ুনঃ খৈয়াছড়া ঝর্ণা – চট্টগ্রাম
কুসুম্বা মসজিদের অবস্থান
সুলতানি আমলের পুরাকীর্তি কুসুম্বা মসজিদ (kusumba mosque)। রাজশাহী বিভাগের নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলায় ৮ নং কুশুম্বা ইউনিয়নের কুশুম্বা গ্রামে কুসুম্বা মসজিদ (Kusumba Mosque) অবস্থিত। আত্রাই নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থিত নওগাঁ জেলার ১১ টি উপজেলার মধ্যে মান্দা অন্যতম। নওগাঁ শহর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরত্বে এবং মান্দা উপজেলা থেকে ৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এটি।
রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়কের মান্দা ব্রিজের পশ্চিম দিকে ৪০০ মিটার উত্তরে অবস্থিত। মসজিদের ভিতরে চারটি কাতারে ৮০ জন মুসল্লী নামাজ আদায় করতে পারে এবং মসজিদের সামনের খোলা স্থানে প্রায় ৭০০ জন মুসল্লী নামাজ আদায় করতে পারে। এছাড়াও পবিত্র রমজান মাসের তারাবির নামাজ পড়ানো হয় এখানে। প্রায় ৫০০ বছরের পুরানো ঐতিহাসিক মসজিদটি নওগাঁ জেলার ইতিহাস এবং মুসলিম স্থাপত্য শিল্পরীতির এক অনবদ্য নিদর্শন।
কুসুম্বা মসজিদের ইতিহাস
কুসুম্বা মসজিদ (kusumba mosque) সুলতানি আমলের সাক্ষী। পাথরের তৈরি ধূসর বর্ণের মসজিদটির ছবি বাংলাদেশের ৫ টাকার নোটে মুদ্রিত আছে। একটি শিলালিপি পাঠ হতে জানা যায়, সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ এর আমলে তার মন্ত্রী বা প্রশাসনিক কর্মকর্তারা মসজিদটির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন ১৪৯৮ খ্রিস্টাব্দে (৯০৪ হিজরী) ।
পরবর্তীতে সুলাইমান নামক এক ব্যক্তি (আফগানি শুর বংশের শাসক গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহ এর আমলে) ১৫৫৮-১৫৫৯ খ্রিস্টাব্দে মসজিদটি নির্মাণ করেন। অর্থাৎ ৯৬৬ হিজরীতে। মসজিদের প্রবেশ পথ থেকে একটু দূরে বাক্স আকৃতির একটি কালো পাথর দেখা যায়।
যা একটি শিশুর কবর হিসেবে লোকমুখে প্রচলিত। পাথরের গায়ে আরবি হরফে লেখা দেখে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, এই প্রস্তরটি হোসেন শাহ এর স্মৃতি বিজড়িত ।
মসজিদের ভেতরে উত্তর-পশ্চিম কোনায় রয়েছে একটি উঁচু স্তম্ভ, যা তৎকালীন সময়ে বিচার কার্য পরিচালনা করার জন্য ব্যবহার করা হতো । ১৮৯৭ সালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে মসজিদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়। মসজিদের উত্তর দক্ষিণ দিকে রয়েছে ৭৭ বিঘার একটি বিশাল দিঘি।
দিঘিটি লম্বায় ১২০০ ফুট এবং চওড়ায় প্রায় ৯০০ ফুট । ২০১৭ সালে মসজিদের চারদিকে এবং পূর্ব পাশে অবস্থিত দিঘির পাড়ে ফুলের বাগান নির্মাণ ও আলোকসজ্জার কাজ করানো হয়। বর্তমানে মসজিদটির দায়িত্বে রয়েছে বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ।
কুসুম্বা মসজিদের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা
ইট পাথরে তৈরি কুসুম্বা মসজিদের স্থাপত্যশৈলী যেন অনবদ্য নিদর্শন। চারকোনা বিশিষ্ট মসজিদটি কালো ও ধূসর বর্ণের পাথর আর পোড়ামাটির ইটে গড়া। এতে ব্যবহার করা হয়েছে মাটির টালি। মসজিদের মূল গাথুনি ইটের হলেও এর সম্পূর্ণ দেয়ালের ভেতর ও বাহির পাথর দিয়ে আবৃত করা। আয়তাকার মসজিদে রয়েছে তিনটি বে এবং দুটি আইল।
মসজিদের চারকোনায় রয়েছে চারটি আটকোনাকৃতির বুরুজ বা মিনার এবং ভিতরে রয়েছে দুইটি প্রশস্ত স্তম্ভ। স্তম্ভ গুলোর গায়ে ঝুলন্ত শিকল ঘন্টার নকশা রয়েছে। ৫৮ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৫২ ফুট প্রস্থের মসজিদের উচ্চতা ৪২ ফুট। চতুর্দিকের দেয়াল ৬ ফুট পুরুত্ব বিশিষ্ট। মসজিদের সামনের দিকে রয়েছে তিনটি দরজা। দুইটি বড় এবং একটি অপেক্ষাকৃত ছোট দরজা।
গ্রামীন চালাঘরের আদলে নির্মিত কুসুম্বা মসজিদের ছাদ উত্তর-দক্ষিনে ইষৎ বক্র। ছাদের ওপর দুইটি সারিতে রয়েছে ছয়টি গম্বুজ। মসজিদের মেহরাব গুলোতে রয়েছে পাথরের খোদায় করা নকশা এবং কিবলার দেওয়াল জুড়ে রয়েছে গোলাপের নকশা। সবগুলা মেহরাব কালো পাথরে তৈরি। মসজিদের কেন্দ্রীয় মেহরাবটি পশ্চিম দিকের দেয়ালের থেকে আলাদা।
বর্তমানে মসজিদের (kusumba mosque) পেছনের দিকে রয়েছে একটি হিফজখানা, মক্তব এবং লীল্লাহ বোর্ডিং। সরকারি অনুদান এবং এলাকাবাসীর দানে এগুলোর কার্যক্রম পরিচালিত হয়। বছরের যেকোনো সময়ে বিশেষ করে শীতকালে ঐতিহাসিক এ স্থাপনা দেখার জন্য পর্যটকরা যায়।
আরও পড়ুনঃ কার্জন হল (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
কিভাবে যাবেন
বাসে কুসুম্বা মসজিদ : রাজধানী ঢাকা থেকে কুসুম্বা মসজিদে (kusumba mosque) যেতে হলে প্রথমে নওগাঁ জেলায় যেতে হবে। সড়কপথে ঢাকা থেকে নওগা জেলার দূরত্ব ২৩৬ কিলোমিটার। এই রুটের কিছু বাসের তালিকা নিচে দেওয়া হলো।
নন-এসি বাস
- শাহ্ ফতেহ্ আলী
- হানিফ এন্টারপ্রাইজ
- শ্যামলী এন আর ট্রাভেলস
- এস আর ট্রাভেলস
- একতা ট্রান্সপোর্ট
- এস আই এন্টারপ্রাইজ
এসি বাস
- শাহ্ ফতেহ্ আলী
- হানিফ এন্টারপ্রাইজ
- এস আর ট্রাভেলস
- এস আই এন্টারপ্রাইজ
নন-এসি এবং এসি বাসের টিকেট মূল্য ৪০০ থেকে ১৪০০ টাকা। বাস অপারেটরের প্রকারের উপর নির্ভর করে ভাড়া। অনলাইনেও টিকেট কাটতে পারবেন। কিছু ওয়েবসাইটের নাম দেওয়া হলো।
- bdtickets.com
- shohoj.com
- busbd.com.bd
ট্রেনে কুসুম্বা মসজিদ
ট্রেনে কুসুম্বা যেতে চাইলে সান্তাহার স্টেশনে নামতে হবে। ঢাকা থেকে সান্তাহারের দূরত্ব ২৫০ কিলোমিটার। এই রুটে চলাচলকারী ট্রেনের তালিকা দেওয়া হলো।
- একতা এক্সপ্রেস (৭০৫)
- লালমনি এক্সপ্রেস (৭৫১) – শুক্রবার বন্ধ
- দ্রুতযান এক্সপ্রেস (৭৫৭)
- নীলসাগর এক্সপ্রেস (৭৬৫) – সোমবার বন্ধ
- রংপুর এক্সপ্রেস (৭৭১) – সোমবার বন্ধ
- পঞ্চগড় এক্সপ্রেস (৭৯৩)
- কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেস (৭৯৭) – বুধবার বন্ধ
ট্রেনের টিকেটের মূল্য নিচে দেওয়া হলো –
- শোভন – ৩০০ টাকা
- শোভন চেয়ার – ৩৬০ টাকা
- প্রথম সিট – ৪৮০ টাকা
- প্রথম বার্থ – ৭১৫ টাকা
- স্নিগ্ধা – ৬০০ টাকা
- এসি সিট – ৭১৫ টাকা
- এসি বার্থ – ১০৬৫ টাকা
নওগাঁ বাস টার্মিনাল থেকে বাস, মাইক্রোবাস, সিএনজি, অটোরিকশা বা ইজিবাইক ভাড়া করে মান্দা উপজেলার কুসুম্বা গ্রামে চলে যাবেন। মান্দা ব্রীজ নামক একটি ব্রীজ রয়েছে রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়কে। ব্রীজের পশ্চিম দিকে গিয়ে ৪০০ মিটার উত্তরে গেলেই দেখতে পাবেন ঐতিহাসিক কুসুম্বা মসজিদ।
কোথায় খাবেন
নওগাঁ জেলাতে থাকার জন্য উল্লেখযোগ্য কয়েকটি আবাসিক হোটেলের নাম দেওয়া হলো –
- হোটেল অবকাশ : ০৭৪১-৬২৩৫৬
- হোটেল ফারিয়াল : ০৭৪১-৬২৭৬৫
- হোটেল যমুনা : ০৭৪১-৬২৬৭৪
- হোটেল রাজ : ০৭৪১-৬২৪৯২
- হোটেল আগমনী : ০৭৪১-৬৩৩৫১
- হোটেল সরণী : ০৭৪১-৬১৬৮৫
- হোটেল প্লাবন
- মোটেল চিশতী
খাবারের জন্য নওগাঁর জনপ্রিয় দেলুয়াবাড়ি বাজারে যেতে পারেন। মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের মিষ্টি খেতে একদম ভুলবেন না কিন্তু। নওগাঁ জেলা মিষ্টির জন্য বিখ্যাত। এছাড়াও বেশ কিছু মিডিয়াম লেভেলের রেস্টুরেন্ট রয়েছে। সুলভ মূল্যে পেয়ে যাবেন খাবার। ছুটির দিনে চলে আসুন প্রাচীন কুসুম্বা মসজিদে।
শেষকথা
আশা করছি কুসুম্বা মসজিদ (kusumba mosque) সম্পর্কে একটি ধারণা পেয়ে গিয়েছেন। যা কিনা আপনার ভ্রমণে সাহায্য করবে। মসজিদটি দেখতে বছরের যে কোন সময় দর্শনার্থীরা ভিড় করেন। পর্যটন শিল্পের বিপুল সম্ভাবনা থাকা সত্বেও প্রয়োজনীয় নজরদারির অভাবে কুসুম্বা মসজিদ আকর্ষণীয় পর্যটন স্পট হিসাবে এখনো গড়ে ওঠেনি। তাই সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতি বছর শীতের সময় অনেকে এ মসজিদ পরিদর্শনে আসেন।
কুসুম্বা মসজিদ সম্পর্কিত প্রশ্ন এবং উত্তর / FAQ
১. কুসুম্বা মসজিদ কোথায় অবস্থিত?
উত্তর : রাজশাহী বিভাগের নওগাঁ জেলায় ঐতিহাসিক কুসুম্বা মসজিদ অবস্থিত।
২. বাংলাদেশের কয় টাকার নোটে কুসুম্বা মসজিদের ছবি ছাপা হয়েছে?
উত্তর : ৫ টাকার নোটে।
৩. বর্তমানে কুসুম্বা মসজিদের দায়িত্বে কে আছে?
উত্তর : বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ।
৪. কুসুম্বা মসজিদ কে নির্মাণ করেন?
উত্তর : আফগানি শুর বংশের শাসক গিয়াসউদ্দিন বাহাদুর শাহ এর আমলে সুলাইমান নামক এক ব্যক্তি প্রাচীন কুসুম্বা মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। সুলাইমান ছিলেন ধর্মান্তরিত হওয়া এক মুসলিম।
৫. কুসুম্বা মসজিদের নির্মাণকাল কখন?
উত্তর : কুসুম্বা মসজিদ এর নির্মাণকাল ১৫৫৮-১৫৫৯ খ্রিষ্টাব্দ ( ৯৬৬ হিজরী)।
আরও পড়ুন –
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সাভার, ঢাকা
সিলেটের দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ